ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম # চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে জিডিপির প্রবৃদ্ধির এমন পূর্বাভাসের খবর জানিয়ে বলেছেন, এটা হবে এখাতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। চলতি অর্থ বছরে গড় মাথাপিছু আয়ও বেড়ে ১৯০৯ আমেরিকান ডলারে দাঁড়ানোর কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি এও বলেছেন যে, গত অর্থবছরে জিডিপি এর প্রবৃদ্ধি ৭.৮৬ শতাংশ এবং গড় মাথাপিছু আয় ১৭৫১ ডলার ছিল- এ বছর সেবা ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ায় তা গড় মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। হাতে চার মাস বাকি থাকলেও সামগ্রিক আর্থিক চিত্র দেখে বলা হচ্ছে বছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়বে। ও মাথাপিছু আয়ের যে ফিগার দেয়া হয়েছে তা বছর শেষে আরও বেশিও হতে পারে। অপরদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যক্তি চাহিদা, ব্যক্তি খাতে ভোগের চাহিদা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়া, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা অব্যহত থাকা এবং অবকাঠামো খাতে সরকারের ধারাবাহিকভাবে চলা উন্নয়নে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। এডিবির আউটলুক ২০১৯’র প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ এ কথা জানান। এডিবি ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সন চ্যাং হং সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কৃষি ফলন বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও তেলের দাম কম হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।
সন চ্যাং হং বলেন, ২০১৮ সালে ৭ দশমিক ৯ এবং ২০১৭ সালে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম। ১৯৭৪ সালের পরে এটা বড় অর্জন। রফতানি, পণ্যের সরবরাহ ও শিল্পের বিকাশ সঠিক পথে আছে। হাতেগোনা যে কয়টি দেশে ৭ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। তবে প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বর্তমানের চেয়ে অনেক বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব পরিসর সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধির চলমান গতিধারা থেকে অনুমান করা যায়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।
বিবিএসের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ব্যক্তি খাতের ভোগ ও সরকারি ব্যয়। অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াতে হলে এবং টেকসই রাখতে হলে বিনিয়োগে আরও গতিশীলতা দরকার। অবশ্য গত কয়েক বছরে বিনিয়োগের বেশ গতি ফিরে এসেছে। অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১ হাজার ১১২ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৫২ ডলার। ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৬৪০ ডলার। তবে এতো সাফল্যের পরও দারিদ্র্য বিমোচন ও কাক্সিক্ষত সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করার জন্য আরও অনেক পথ এগোতে হবে। এখনও দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ দরিদ্র। একই সঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে বৈষম্য কমানোর বিষয়টিকে। প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে এর সঙ্গে কর্মসংস্থান যাতে বাড়ে সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিতা রক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়নে নেয়া মেগা প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করতে হবে।
যে কোন দেশে প্রবৃদ্ধির ধারা সুসংহত ও টেকসই করতে হলে অর্থনীতির বিকাশের পর্যায়ে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি থাকাটা কাক্সিক্ষত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত কাঠামোগত রূপান্তরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে শিল্প ও সেবা খাত। কমছে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান। স্থিতিশীল রয়েছে সেবা খাতের অবদান। তবে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়লেও সমান্তরালভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়েনি। এখনও দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশই কৃষি খাতের ওপর নিভর্রশীল। অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হারও কৃষি খাতে অনেক বেশি। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কর্মসংস্থানের এ দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টানো প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে মোট বিনিয়োগ ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বিনিয়োগের হার যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
কিন্তু মধ্য মেয়াদে উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য এ বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিগুলোর অবদান বিবেচনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ বিনিয়োগ হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ব্যক্তি ও সরকারি খাতের বিনিয়োগের হার হবে যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পরিকল্পনা মেয়াদের প্রথম তিন বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বড় অবকাঠামো প্রকল্প চলমান আছে, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং কর্মসৃজন অগ্রাধিকার পেয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচন ত্বরান্বিত করা, লিঙ্গ সমতা অর্জনে অগ্রগতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ব্যাপকসংখ্যক অনগ্রসর মানুষ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পরিকল্পনার আওতায় প্রত্যেক নাগরিক যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে সে জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ব্যাপকভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয় দশমিক ছয় শতাংশ।
মূলত ব্যক্তি খাতের ভোগ এবং বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। গত পাঁচ বছরে কৃষি উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬ এবং ৬ শতাংশ। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর চলতি বছর শেষে প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ বলে আশা করা হচ্ছে এবং প্রতি বছর এক শতাংশ মানুষকে করের আওতায় আনতে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ১ শতাংশ হারে বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বর্তমানে দেশের মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। আর সামগ্রিকভাবে ১৪ শতাংশ মানুষ সরকারকে নানাভাবে রাজস্ব দেয়। এই সংখ্যাটা কমপক্ষে ২০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সরকার। এ জন্য আগামী পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, প্রাক্কলিত এ বাজেট সর্বকালের সর্ববৃহৎ।
সর্ববৃহৎ এ ব্যয়ের চাপ মেটাতে প্রাক্কলিত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্কলিত আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। কারণ গত সাত মাসে এনবিআরের গ্রোথ রেট ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি যোগ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, যা বাজেটের আয়ের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এতে ঘাটতির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সরকার উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যয় প্রায় আড়াই গুণ বাড়িয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীমূলক কর্মসূচিগুলো জোরদার করেছে। দেশ-বিদেশে প্রায় এক কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বিশ্বমন্দার অভিঘাত সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে গড়ে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। প্রবৃদ্ধি টেকসই এজন্য হয়েছে যে, গত চার বছরে দারিদ্র্য প্রায় ১২ শতাংশ দারিদ্র্যতা কমেছে। ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। সরকারের সুষম প্রবৃদ্ধি-সহায়ক নীতি ও আন্তরিকতা এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের জন্য বেশ প্রণোদনা যুগিয়েছে। সরকারের এ কল্যাণধর্মী মানসিকতা বজায় রাখতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। সে চেষ্টাটি জনগণকেই করতে হবে।
[লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার]
Be the first to comment on "প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে"