মিঠুন কুমার দত্ত # জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, অবিলস্বে পদক্ষেপ না নিলে পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষের জীবন-জীবিকার উপর বড় ধরণের প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য সবকিছুই হুমকির মুখে পড়বে। এরমধ্যে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি হুমকীতে রয়েছে তার অন্যতম বাংলাদেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এপর্যন্ত যতগুলো প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে তার মধ্যে আইপিসিসির এই প্রতিবেদনটি সবচেয়ে ব্যাপক বলে বর্ণনা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০০৭ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব তারা দেখেছিলেন এই প্রতিবেদনে সেটি দ্বিগুণ হয়েছে। এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলোকে উপেক্ষা করার কোন কারণ থাকতে পারে না। কারণ এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো বেশ ব্যাপক ও বিষয়টি গুরুতর। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে উষ্ণতা যেমন বাড়বে তেমনি হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। তাই উন্নত দেশগুলোতে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন অবশ্যই কমাতে হবে।
ওই প্রতিবেদনটি তৈরির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সালিমুল হক। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রীন হাউজ গ্যাস নিগর্মন কমাতে না পারলে আগামী ৫০ কিংবা ১০০ বছরে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। তাপমাত্রা বেড়ে যদি চার ডিগ্রি হয় তাহলে এর সাথে খাপ খ্ওায়ানো যাবে না। এতে করে বাংলাদেশে বন্যা ও সাইক্লোনের প্রবণতা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে খাদ্য ও জীবন-জীবিকার উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। সংকটের মুখে পড়বে কৃষি উৎপাদন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি, যা এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এখনো কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। বিবিএস ২০১৪-১৫ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ১০ লাখ এবং প্রতি বছর ২০ লাখ লোক জনসংখ্যায় যোগ হচ্ছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে হবে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি। এ বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ আবশ্যক। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর।
ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য, আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে বিবেচিত। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। কারণ কৃষিতে সূর্যের আলো, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতার মৌসুমভিত্তিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ফসলের ধরন, জাত, চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। এ কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসম বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি, খরা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব ও মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদি এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ কৃষি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে মুহূর্তের মধ্যেই আক্রান্ত এলাকার ফসল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, জীবজন্তু, ঘরবাড়ি ও মানুষসহ সবই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন ‘সিডর’, ‘আইল্যা’, ‘বুলবুল’-এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর নদীভাঙনের ফলে প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। প্রতি বছরই নদীর কূল ভেঙ্গে অনেক কৃষি জমি, বসতি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কৃষি জমি কমে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং নদীর দুই-কূলবর্তী অসংখ্য মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব ভাসমান মানুষে পরিণত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় অতিবর্ষণের সময় উঁচু এলাকার উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুয়ে ক্ষয়ে যায়, কখনও কখনও ভূমি ধস হয়। ফলে এসব এলাকার মাটি ক্রমান্বয়ে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মরুকরণসহ অন্যান্য কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটছে। যা মানবকল্যাণ ও জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ু ইস্যুতে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠনের জোট নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশ (এনসিসি’বি)’র এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, গাইবান্ধার আওতাধীন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের ফলে প্রায় এক লক্ষ হেক্টর জমি হ্রাস পেয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ভাঙনের ফলে গাইবান্ধার অধীন ফুলছড়ি উপজেলায় ১৩৭ হেক্টর জমি হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা নদী তীর ভাঙ্গনের কারণে রাজশাহী জেলার গোদাগাঙী উপজেলা ১৪৪ হেক্টর ও কুড়িগ্রামের চিলমারী থেকে দুই হাজার ৩০৪ হেক্টর জমি হারিয়েছে। আর কৃষি জমি কমে যাওয়া ও আবহাওয়ার অস্বাবিকতার কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর বড় ধরণের প্রভাব ফেলছে।
এ বিরূপ পরিস্থিতির সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরির্বর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। এ রকম অবস্থায় দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযোগী কলাকৌশল ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন সব থেকে বড় হুমকি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কারণে আগামী ১০০ বছরে এশিয়া অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে। বিশেষ করে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ধান উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। আরো বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে ধরণের সমস্যা হয় সেটা অল্প সময়ে সমাধান করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
ইকো-সিস্টেমভিত্তিক স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনার ভিত্তিতে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশ (এনসিসি’বি)। এনসিসিবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণঅংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দেশের প্রধান ছয়টি ইকো সিস্টেমের (খরা প্রবণ অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, বন্যা প্লাবন ভূমি, চরাঞ্চল ও হাওর এলাকা) জন্য ইকোসিস্টেম ভিত্তিক স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের হাত থেকে বিপন্ন মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় অভিযোজনের বাইরে লস এন্ড ড্যামেজ মোকাবেলার একটি জাতীয় কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯
Be the first to comment on "জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকিতে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা"