সর্বশেষ

করোনা পরিস্থিতিতে ভয়াবহ সংকটে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা

সাকিলা পারভীন : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশও লকডাউন চলছে। সারা দেশের মানুষকে নিজ নিজ বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। যা দফায় দফায় ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আর এই লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা মারাÍকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সেবা গ্রহণের জন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে অত্যাধুনিক মানের গর্ভনিরোধকের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেশে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল চত্বরে ভ্যানের উপর গৃহবধু শিমুলী রানী দাসের সন্তান প্রসবের ঘটনায় সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ঘটনায় দেখা গেছে গত পহেলা মে সকালে সাতক্ষীরার সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়নের ছনকা গ্রামের বিধান দাসের স্ত্রী শিমুলী রানী সন্তান প্রসব করেন। তার মা অষ্টুমী রানী দাস জানান, প্রসব বেদনায় মেয়েকে নিয়ে সাতক্ষীরার দু’টি বেসরকারী ক্লিনিক ঘুরে সদর হাসপাতালে গেলে জরুরী বিভাগের চিকিৎসকরা কোন চিকিৎসা দেয়নি। কিছুক্ষণ পরই মেয়ের প্রসব বেদনা উঠে। হাসপাতাল চত্বরে ভ্যানের উপর সে সন্তানের জš§ দেয়। তিনি আরো জানান, শিমুলী গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চললেও করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দেড় মাসে তা সম্ভব হয়নি। এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদেরও দেখা পাওয়া যায়নি। ফলে কখন প্রসব বেদনা উঠবে তা বুঝতে না পারায় তাদেরকে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে লকডাউন চলায় বিভিন্ন স্থানে এধরণের ঘটনা ঘটছে। গত ১১ মে পাংশা উপজেলার বলরামপুর থেকে কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে লিপি আক্তার মারা যান। জরুরী সিজার করার প্রয়োজন হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে যানবাহনের অভাবে তার পরিবারকে সংকটে পড়তে হয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াতেও একই ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এই সময়ে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়া ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যেতে চান না। আবার মাঠ পার্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সময়মতো পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনিরাপদ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে। আবার লকডাউনের কারণে বাজারে অত্যাধুনিক মানের গর্ভনিরোধক বা কন্ট্রাসেপ্টিভের চাহিদা বেড়েছে এবং সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের হারও বাড়ছে বলে জানাগেছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)’র এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ ধরণের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ইমপ্যাক্ট অব দ্য কোভিড-১৯ পেনডেমিক অন ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড এনডিং জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন অ্যান্ড চাইল্ড ম্যারেজ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের ১১৪টি দেশে প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের হার বাড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে নারী ও মেয়েশিশুর প্রজননস্বাস্থ্য। বিশেষ করে বাল্য বিবাহের শিকার নারীরা সবচেয়ে সংকটে পড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা পূরণে বাধা, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকট বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যথাযথ সেবাদানে বিঘ্ন ঘটছে। করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে সেবা নিতে যাওয়া নারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান লকডাউন ছয় মাস অব্যাহত থাকলে বিশ্বে অতিরিক্ত ৭০ লাখ অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করবে। এক্ষেত্রে নিরাপদ গর্ভপাত নিয়েও সংকট দেখা দিবে।
প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ইউএনএফপিএ’র সঙ্গে কাজ করছে জাতীয় সংসদের মহিলা ও শিশু বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। ওই কমিটির দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ প্রজননক্ষম (১৫-৪৯ বছর) জনসংখ্যা। আর ৬২ শতাংশ সক্ষম দম্পতি গর্ভনিরোধক ব্যবহার করে থাকেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক দম্পতি নিরাপদ গর্ভনিরোধক ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাদের মতে, দেশের এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নেওয়ার হার কমবে। সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে চাইবে না মায়েরা।
একই ধরণের তথ্য দিয়েছেন মেরিস্টোপস বাংলাদেশ। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে নারীরা জš§নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা যেমন- নিরাপদ গর্ভপাত, নিরাপদ প্রসবসেবা এবং প্রসবোত্তর পরিবার পরিকল্পনা সেবাও সঠিকভাবে পাচ্ছে না। বাংলাদেশ বিষয়ে সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতি তিন মাস থাকলে ৮০ ভাগ সেবা কমে যেতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গৃহবন্দী মানুষ অলস সময় কাটাচ্ছে। ফলে নারীদের গর্ভধারণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেওয়ার কার্যক্রমও কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। এই অবস্থার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, যেদিকে নজর না দিলে বিপদ আরো বাড়বে বলেই আশংকা করা হচ্ছে। তার মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য অন্যতম, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সময়কে অতীব গুরুত্বের সাথে দেখা এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সকল বিষয়ের সাথে আর একটি বিষয় জড়িয়ে আছে তা হলো নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক।
ইতিহাস বলে, এই ধরণের অবস্থার পরপরই গর্ভধারনকারী এবং বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকলেও এখন তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এরপরও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বিভিন্ন মিডিয়ার সাহায্যে সচেতনতা তৈরীর কাজ করছে। এই বিপদকালীন সময়ে আলাদাভাবে তথ্য ও সেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে যথাযথ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। প্রসবকালীণ ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের জন্য সেবাকেন্দ্রসমূহ খোলা রাখা হয়েছে। তবে সেই সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি)ও কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তাদের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থাসমূহকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা মেনে এই সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে হটলাইন ও তথ্যসেন্টার সম্পর্কে প্রচারণা বৃদ্ধির জন্যেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সুস্থ্য জীবনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ ও নিরাপদ শারীরিক সম্পর্কে সচেতন হওয়া একান্ত আবশ্যক।
###

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১৯ মে ২০২০ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "করোনা পরিস্থিতিতে ভয়াবহ সংকটে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*