সর্বশেষ

বাজেট অধিবেশনে এমপি করোনা পজিটিভ, সংসদে আতঙ্ক

মিঠুন কুমার দত্ত : নতুন দুজন সংসদ সদস্য কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ের মোট ৬৭ কর্মীর দেহেও সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নতুন আক্রান্ত সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এবং গণফোরামের মোকাব্বির খানকে নিয়ে এপর্যন্ত মোট ১১ জন সংসদ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খানের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে মঙ্গলবার দুপুরে। তিনি গত ১০ জুন বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন সংসদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। করোনা আক্রান্ত এই সংসদ সদস্যের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার খবরে সংসদে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক হুইপ। তারা বলেন, অধিবেশনে যোগ দেওয়া সংসদ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় অধিবেশনের বাকি কার্যদিবস গুলোতে সংসদ সদস্য ও কর্মকর্তা কর্মচারিদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে গেল। অধিবেশন কক্ষে তার সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে বলে সংস্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংসদ সচিবালয় সুত্র জানায়, করোনা আক্রান্ত সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মোহাম্মদ নাসিম এবং টেকনোক্র্যাট কোটার প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ের মোট ৬৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ পরীক্ষার পর সোমবার পর্যন্ত ৬৭ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. নুরুজ্জামান বলেন, আক্রান্তদের সবাই অবশ্য সরাসরি সংসদ সচিবালয়ের নয়। এখানে সংসদ ভবন সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
এদিকে করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে চলমান বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সংসদ সচিবালয়। এক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং বয়স্ক সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংসদের চলতি অধিবেশনে অন্তত ৪০ জন সংসদ সদস্যকে যোগ না দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে সংসদের হুইপের দফতর থেকে ফোন করে তাদের সংসদে যোগ না দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও সরকারি দলের প্রভাবশালী সদস্যরাও রয়েছেন। রয়েছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও।
জানা গেছে, বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেসব সংসদ সদস্য ঝুঁকিপূর্ণ, যেসব সদস্য বা তাদের পরিবারের কারও করোনা পজিটিভ হয়েছে এবং করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে গেছেন, তাদের সংসদে না যেতে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণের মধ্যে কোনও সংসদ সদস্যের টানা ৯০ দিন অধিবেশনে অনুপস্থিতির আশঙ্কা থাকলে, তাদের হাজিরা দিতে একদিনের জন্য অধিবেশনে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সংসদে প্রতিদিন এমপিদের উপস্থিতি ৬০ থেকে ৮০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে উপস্থিতি কোনও ক্রমেই যেন ৯০ জনের বেশি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কারণে অধিবেশন শুরুর আগেই সংসদের সরকারি ও বিরোধী দলের হুইপরা বসে রোস্টার করেছেন। প্রত্যেক সদস্যের গড়ে তিন দিনের উপস্থিতির সুযোগ রেখে রোস্টার করা হয়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলতি সংসদের কার্যদিবস তিন থেকে চার দিনের মতো কমিয়ে আনার কারণে এমপিরা আরও কম উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনও কোনও সদস্য একদিন বা দুই দিনের বেশি উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না।
জানা গেছে, রোস্টার তৈরির আগে অধিবেশনে একেবারেই অংশগ্রহণ করবেন না, এমন আক্রান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের তালিকা তৈরি করা হয়। এমন অন্তত ৩৫ জনের তালিকা তৈরি করে তাদের অধিবেশন শুরুর আগেই না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনও কোনও সংসদ সদস্য নিজে, তার পরিবারের সদস্য বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীর করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে এই সংখ্যা ইতোমধ্যে বেড়েছে। অধিবেশনের বাকি সময়ের মধ্যে এই তালিকা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অসুস্থ ও বয়স্কদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করার কারণ হিসেবে হুইপরা জানান, অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য এমপিদের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলেও অধিবেশন চলাকালে আরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ সদস্যসহ সাপোর্টিং স্টাফ, গ্যালারিতে অবস্থানকারী অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ অত্যাবশ্যকীয় কিছু ব্যক্তিবর্গ মিলিয়ে দেড় শতাধিক মানুষ অধিবেশন কক্ষে অবস্থান করেন। বায়ুবিরোধী ও সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ কক্ষে তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মূলত এ কারণে অসুস্থ ও বয়স্কসহ আক্রান্ত ও আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা সংসদ সদস্যদের না আসতে অনুরোধ করা হয়েছে।
শারীরিক অসুস্থতা ও বয়সের কারণে যেসব সংসদ সদস্যকে অধিবেশনে না আসতে অনুরোধ করা হয়েছে তারা হলেন, বিরোধীদলীয় নেতা ও ময়মনসিংহ-৪ আসনের এমপি রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা ও ফরিদপুর-২ আসনের সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ঝালকাঠী-২ আসনের আমির হোসেন আমু, ভোলা-১ আসনের তোফায়েল আহমেদ, গোপালগঞ্জ-২ আসনের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঢাকা-১৮ আসনের অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, চট্টগ্রাম-১ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশররফ হোসেন, ফরিদপুর-৩ আসনের খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বরিশাল-১ আসনের আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, নওগাঁ-৪ আসনের ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, জামালপুর-১ আসনের আবুল কালাম আজাদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ঢাকা-৮ আসনের রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি ও পিরোজপুর-২ আসনের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সরকারি দলের সংসদ সদস্য শেরপুর-৩ আসনের একে এম ফজলুল হক, পাবনা-৩ আসনের মকবুল হোসেন, ময়মনসিংহ-৬ আসনের মোসলেম উদ্দিন, পটুয়াখালী-১ আসনের মো. শাহজাহান মিয়া, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের মো. দবিরুল ইসলাম, সরকারি দলের হুইপ ও খুলনা-১ আসনের পঞ্চানন বিশ্বাস, সংরক্ষিত আসনের শেখ এ্যানী রহমান ও জিন্নাতুল বাকিয়া এবং বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার। এছাড়া, সংরক্ষিত আসনের সদস্য ও রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খানকেও অনুরোধ করা হয়েছে অধিবেশনে যোগ না দিতে।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এর নামা প্রথমে এ তালিকায় না থাকলেও তারা দুই জন করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এছাড়া করোনা পজিটিভ হওয়ার জন্য নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকার, চট্টগ্রাম-৬ আসনের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, যশোর-৪ আসনের রণজিৎ কুমার রায়, জামালপুর-২ আসনের ফরিদুল হক খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের এবাদুল করিম, চট্টগ্রাম-৮ আসনের মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে সংসদ অধিবেশনে যোগ না দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অবশ্য এদের মধ্যে শহীদুজ্জামান সরকার ও এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন। এদিকে সংসদের তথ্য অনুযায়ী, ফজলে করিম চৌধুরী করোনা আক্রান্ত হলেও গণমাধ্যমের কাছে তিনি তা অস্বীকার করেছেন।
পরিবারের সদস্যদের করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), রাজবাড়ী-১ আসনের কাজী কেরামত আলী, যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ ও টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলামকে (টিটু) অধিবেশনে যোগ না দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া, ব্যক্তিগত সহকারী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় নতুন করে বাগেরহাট-২ আসনের শেখ তন্ময়কেও অধিবেশনে যোগ না দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অবশ্য ব্যক্তিগত সহকারীর করোনা পজিটিভ হওয়ার খবরে শেখ তন্ময় নিজেই হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। এদিকে পরিবারে অসুস্থ ও বয়স্ক সদস্য (বৃদ্ধ মা) থাকায় বাগেরহাট-১ আসনের শেখ হেলাল উদ্দিনকে আগেই অনুরোধ করা হয়েছে এবারের অধিবেশনে যোগ না দিতে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে বৈঠকে উপস্থিত না থাকার বিষয়ে হুইপের দফতর থেকে কোনও অনুরোধ জানানো হয়নি। তবে গত বছর মারাত্মক অসুস্থতা নিয়ে সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া ওবায়দুল কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পরপরই বাসা থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা দেন। ওবায়দুল কাদের বর্তমানে অধিবেশনে যোগ না দিলেও গত ১১ জুন সংসদে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।
অবশ্য সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের অধিবেশনে যোগ না দিতে অনুরোধ বা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তাদের কেউ কেউ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। জানা গেছে, অধিবেশনে যোগ না দিতে অনুরোধ সত্ত্বেও গত ১০ জুন বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনে জামালপুর-১ আসনের সরকারি দলের এমপি আবুল কালাম আজাদ অধিবেশনে যোগ দেন। তাকে সংসদের প্রবেশ পথে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অধিবেশন কক্ষে যোগ না দিতেও অনুরোধ করেছিলেন। পরে তিনি বৈঠকে যোগ দেন।
সংসদের অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার অনুরোধ প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, তাকে অনুরোধ করে অধিবেশনে যোগ না দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, আপনার অধিবেশনে যোগ না দিলেও চলবে। অধিবেশনে যাবেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে সংখ্যায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে সংসদ ভবন অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঝুঁকির কারণে সংসদের বৈঠকও কাটছাঁট করা হয়েছে। সামনে যে কয়দিন চলবে সেটাতে কী হয় তা বলা মুশকিল।
জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, তারা কোনও সংসদ সদস্যকেই অধিবেশনে যোগ দিতে নিষেধ করেননি। করোনাভাইরাসজনিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রবীণ ও অসুস্থ সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন। সংসদের সিনিয়র সদস্যদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। তবে যারা করোনা পজিটিভ তাদের সবাইকে নিষেধ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও দুই-একজন সিনিয়র সদস্য ইতোমধ্যে অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন বলেও হুইপ স্বপন জানান।
###

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১৬ জুন ২০২০ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "বাজেট অধিবেশনে এমপি করোনা পজিটিভ, সংসদে আতঙ্ক"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*