ঢাকা: এক সময়ে সভা-সমাবেশে নারীদের অংশগ্রহণকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হতো। সমাজের সেই ভুল দৃষ্টিভঙ্গির তোয়াক্কা না করে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন সাহারা খাতুন। এরপর আর পিছপা হননি। রাজনীতিকেই ধ্যানজ্ঞান করেছেন। কয়েক দশকের রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগের অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন। তিনি কখনোই দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে সরব থেকেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় কম গিয়েও নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দেননি। তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বৃহস্পতিবার রাতে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গতকাল শুক্রবার রাত ১টা ৩০ মিনিটে ইউএস-বাংলার বিশেষ ফ্লাইট বিএস২১৪-এ তাঁর মরদেহ দেশে পৌঁছার কথা। আজ শনিবার জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে। সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারিমন চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনরা।
স্পিকার এক শোকবার্তায় বলেছেন, সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো। চিরকুমারী রাজনীতি অন্তপ্রাণ এই নারীর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের এক পরীক্ষিত নেতাকে হারাল। মরহুমার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান স্পিকার।
ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন সাহারা খাতুন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতা হাবীব হাসান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উনার মতো মহানুভব নেত্রী, ভালো মানুষ, নিরহংকারী, কর্মীপ্রিয় নেত্রী আমরা আর পাব না। উনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তিনি একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে আমৃত্যু রাজনীতি করে গেছেন।’
সাহারা খাতুন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। হাতে গোনা যে অল্পসংখ্যক নারী নেত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, সাহারা খাতুন তাঁদের অন্যতম। একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই নারী আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে জায়গা করে নেন।
কর্মী অন্তপ্রাণ হিসেবে সাহারা খাতুন পরিচিত ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের কর্মসূচিতে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনে সাহারা খাতুন সামনের সারিতে থাকতেন। নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হলে তিনি তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে নিজে আহত হয়েছেন বহুবার। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যেতেন দলের নেতাকর্মীদের মামলায় আইনি লড়াই করতে। অ্যাডভোকেট হিসেবে তিনি বিনা পয়সায় নেতাকর্মীদের জামিন করাতেন।
নিজের যোগ্যতাবলেই সাহারা খাতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন নারী হয়ে সততা ও সাহসের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সামলেছেন। সর্বশেষ তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী সাহারা খাতুন ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার পরাজিত হলেও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হন সাহারা খাতুন। এরপর আরো দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য হন তিনি।
আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাহারা খাতুন আলোচিত এক-এগারোর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। আওয়ামী লীগের সেই দুর্দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে দলে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
মাঠ পর্যায়ে সংগঠন করার মধ্য দিয়ে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন গড়েছিলেন সাহারা খাতুন। ৭৭ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে জাতি এক গুণী রাজনীতিবিদকে হারাল।
গত ২ জুন বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় সাহারা খাতুনকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে এক মাসের বেশি সময় চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৬ জুলাই সোমবার তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে মারা যান সাহারা খাতুন।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১১ জুলাই ২০২০ ইং
Be the first to comment on "তৃণমূল কর্মীদের ভরসাস্থল ছিলেন এমপি সাহারা খাতুন"