সর্বশেষ

দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের জীবনমান বদলে দিচ্ছে ‘স্বপ্ন’ প্রকল্প

ঢাকা : কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার হাড়িভাঙ্গা গ্রামের কাজলী রানী শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। একইভাবে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করায় দুই সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার তিলাই ইউনিয়নের মোসাম্মৎ চ¤পা বেগম। ঠিক এ সময় তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘উৎপাদনশীল ও সম্ভাবনাময় কর্মের সুযোগ গ্রহণে নারীর সামর্থ উন্নয়ন (স্বপ্ন)’ প্রকল্প। ফিরে যায় তাদের ভাগ্যের চাকা।

কাজলী ও চ¤পার মত সাতক্ষীরা ও কুড়িগ্রাম জেলার ৮ হাজার ৯২৮ জনগ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীর ভাগ্য বিনির্মাণে কাজ করছে ২০১৫ সালের আগষ্টে শুরু হওয়া ‘স্বপ্ন’ প্রকল্প। দুটি জেলায় ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় ২০২০ সাল থেকে ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের কার্যক্রম লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলায় শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের পিছিয়ে থাকা ২২টি জেলার এক হাজার ৩০টি ইউনিয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ইউএনডিপি, মারিকো-বাংলাদেশ লিমিটেড ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সি (সিডা)’র সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ এই প্রকল্পের আওতায় চরম দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার হতদরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব এবং স্বপ্ন প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন, ‘স্বপ্ন প্রকল্পের মাধ্যমে হতদরিদ্র নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সঞ্চয়ের মানসিকতা তৈরি করা হয়। যাতে তারা কোনোভাবেই দারিদ্র্যের ফাঁদে নতুন করে ফিরে না যান।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামীণ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের কাজে প্রকল্পভূক্ত নারীদের ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। পাশাপাশি বাধ্যতামূলক সঞ্চয় সৃষ্টি করে দক্ষতা উন্নয়ন এবং কারিগরী ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা হয়।’

ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, ‘জাতীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে জোরালো ভূমিকা রাখছে গ্রামের নারীরা। তাদেরকে পিছনে ফেলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাই স্বপ্ন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় গৃহীত ‘স্বপ্ন’ প্রকল্প টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামের হতদরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে অবদান রাখছে। ইউএনডিপি শুরু থেকেই ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কারিগরী সহযোগিতা প্রদান করে আসছে, যাতে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে পিছিয়ে পড়া নারীরা সমাজের মূল ধারায় যোগ দিতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম চক্রে কুড়িগ্রাম ও সাতক্ষীরা জেলার ১২৪টি ইউনিয়নের চার হাজার ৪৬৪ জন উপকারভোগী নারী নিয়ে বিগত ২০১৫ সালের আগষ্ট হতে ২০১৭ সালের ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত মোট ১৮ মাসের চক্র সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ২য় চক্রের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম ও সাতক্ষীরা জেলার ১২৪টি ইউনিয়নের অধীনে চার হাজার ৪৬৪ জন নতুন নারী উপকারভোগী নিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর হতে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ১৮ মাসের চক্র সম্পন্ন হয়েছে। ৩য় চক্রে জামালপুর, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার ৯৯টি ইউনিয়নে তিন হাজার ৫৬৪ নতুন নারী উপকারভোগী নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে কাজ শুরু করেছে। এ পর্যন্ত ২০০ উপকারভোগী নারীবান্ধব ও উন্নতমানের তৈরী পোশাক কারখানায় চাকুরী পেয়েছে।

স্বপ্ন প্রকল্পের উপকারভোগী চ¤পা জানান, ‘দুই সন্তানকে নিয়ে আমি চলে আসি বাবার বাড়িতে। আমার কোন অর্থ ছিলো না, যা দিয়ে মা-বাবাকে সহযোগিতা করতে পারি। অর্থের জন্য এখানে সেখানে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করি। কিন্তু বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য কাজ ফেলে মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসায় অনেকেই কাজে রাখায় আগ্রহী ছিলনা। তাই সব সময় কাজ পেতাম না। তবে এক দুপুর বেলায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ হতে মাইকে ঘোষণা শুনতে পাই ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের পক্ষ হতে দরিদ্র নারীদের জন্য কাজ এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এরপর ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করি এবং পরে লটারীতে জিতে এই প্রকল্পে যোগদান করি।’

মূলতঃ এরপর থেকে চ¤পার ভাগ্য ফিরতে থাকে এবং কাজের মাধ্যমে তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রতিদিন আয় হওয়া শুরু করে। এর পাশাপাশি তিনি ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও গবাদি-পশু পালনের উপর প্রশিক্ষণ নেন। ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের ১২জনের একটি সঞ্চয় ভিত্তিক দল থাকে, যা রোসকা বা টানা সমিতি নামে পরিচিত। চ¤পা রোসকায় অংশ নিয়ে টাকা জমানো শুরু করেন।

নিজের কর্মদক্ষতা, স্বপ্ন প্রকল্প থেকে পাওয়া দৈনিক মজুরী এবং রোসকায় জমানো অর্থ দিয়ে চ¤পা একটি চায়ের দোকান খোলেন। তিনি সকালে ‘স্বপ্ন’তে কাজ করতেন এবং বিকেলে তার নিজের দোকান চালাতেন। ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের ১৮ মাসের কাজের চুক্তি শেষে তার জমানো অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫০০ টাকা। এই টাকাও তিনি তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন, যাতে করে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো যায়। বর্তমানে তার মূলধনের পরিমাণ লক্ষাধিক টাকায় পৌছেছে বলে তিনি জানান।

প্রকল্পে যোগদানের পর সকল উপকারভোগীদের ৭টি বিষয়ের উপর (নেতৃত্ব উন্নয়ন, নারী অধিকার, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, নারী-পুরুষ স¤পর্ক উন্নয়ন, স্বশিক্ষণ সহজ হিসাব, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের করণীয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলার কৌশল) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া উপকারভোগীদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন বিষয়ের (গরু পালন, বসতবাড়িতে সবজি চাষ, ছাগল ও ভেড়া পালন, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন, মাছ ও কাঁকড়া চাষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন) উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক কাজল চ্যাটার্জী বলেন, ‘স্বপ্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার নারী উপকারভোগীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। এই প্রকল্পে স্থানীয় জনগণ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পারিবারিক বিরোধ নিরসনে নারী ও শিশু কল্যাণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি মিলেই উপকারভোগী নির্বাচন করে। এ ক্ষেত্রে সঠিক উপকারভোগী চিহ্নিত করার হার ৯৬ শতাংশ।’

প্রকল্পের সফলতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত জরিপে স্বপ্ন প্রকল্পটি অন্যতম সেরা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে ২০০টি উপজেলায় স্বপ্ন প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্পের শতভাগ উপকারভোগীকে ই-পেমেন্টের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, যা মজুরী প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে। উপকারভোগীরা গড়ে ৩ থেকে ৪টি করে আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সাথে জড়িত। উপকারভোগীদের মোবাইল নম্বর সম্বলিত মোবাইল ডিরেক্টরি মুদ্রিত হওয়ায় তাদের সাথে যোগাযোগ করে প্রকল্পের কার্যক্রম ও তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।’

করোনা মহামারী মোকাবেলা করেও প্রকল্পের ৮০ ভাগ উপকারভোগী তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করছে। উপকারভোগীদের মাঝে ব্যবহারবিধি প্রদর্শনসহ এক লাখ ৯১ হাজার ৪৪টি সাবান ও মাস্ক বিতরণ, ৫ হাজার ৮২৮ জন উপকারভোগীদের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ এবং ৬ হাজার ৬৪ জন উপকারভোগীকে জনপ্রতি এক হাজার ৫০০ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে।

কুড়িগ্রামে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রায় ২০০ উপকারভোগীকে মাস্ক উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। লক্ষাধিক মাস্ক উৎপাদন এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউএনসিডিএফ’র সহায়তায় সাতক্ষীরায় একটি মিনি-গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে ৬০ জন উপকারভোগীর কর্মসংস্থান হয়েছে। কুড়িগ্রামে দু’টি সমিতি- স্বপ্ননারী কল্যাণ সমিতি ও কল্যাণী নারী কল্যাণ সমিতি গঠন করা হয়েছে, যা সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত হয়েছে। ইউএনসিডিএফ’র সহযোগিতায় কুড়িগ্রামে একটি ডেইরি এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরমাধ্যমে প্রায় ৩০০ উপকারভোগীর কর্মসংস্থান হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি মোকাবেলায় ৭ হাজার উপকারভোগী বস্তা পদ্ধতিতে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে আনুমানিক ৩৫ হাজার বস্তায় সবজি চাষ করছে। তাদেরকে রাসায়নিক মুক্ত সবজি উৎপাদনে কেঁচো সার উৎপাদন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রয়ের ও প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সুবিধার্থে ১৭১টি কৃষি পণ্য ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

কুড়িগ্রামে স্বপ্ন প্রকল্পের উপকারভোগীদের নিজস্ব মালিকানা ও তত্ত্বাবধানে স্বল্প মূল্যের স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুত করা হচ্ছে। যার মূল উদ্দেশ্য দরিদ্র নারী ও কিশোরীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। এর ফলে সরাসরি প্রায় ৫০ জন দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে এবং পণ্যটি বিপণনের জন্য প্রায় এক হাজার নারী আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এছাড়া উপকারভোগীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জামালপুরে দু’টি ক্ষুদ্র বীমা পলিসি তৈরি করা হয়েছে। চামড়া শিল্পে যোগদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সেন্টার অফ এক্সিলেন্স ফর লেদার স্কিল বাংলাদেশ লিমিটেডের (কোয়েল) সহায়তায় ৩০টি চাকরিপূর্ব প্রস্তুতিমূলক কর্মশালা করা হয়েছে। প্রায় ৪০০ উপকারভোগীকে চামড়া শিল্পে যোগদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আরো ২০০ উপকারভোগীকে তৈরী পোশাক কারখানায় নিয়োগ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

স্বপ্ন প্রকল্পের সামগ্রিক সাফল্য বিবেচনায় প্রকল্পটি ২২টি জেলায় সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অর্থের অপ্রতুলতার দরুন এতোদিন তা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর বাজেটের আওতায় স্বপ্ন প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এতে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও হতদরিদ্র নারীদের দারিদ্রতা লাঘবের পাশাপাশি সরকারের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে কমবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
###

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১০ মে ২০২১ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের জীবনমান বদলে দিচ্ছে ‘স্বপ্ন’ প্রকল্প"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*