সর্বশেষ

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দরকার গতি নিয়ন্ত্রণ

তোষিকে কাইফু # সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে এবং এতে যেভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে ক্রমেই ক্ষোভ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এ দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮”। সড়ক দূর্ঘটনা হ্রাস ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এ আইন প্রণয়ন করে।

বাংলদেশের বর্তমান আইনটির এখনও কিছু দূর্বল দিক রয়েছে যার জন্য সড়ক ব্যবহারকারীরা আইন লঙ্ঘন ও দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” চলতি বছরে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন সরকার। গাড়ির গতি নিদিষ্ট করে দেওয়া, চালক ও যাত্রীদের জন্য সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক, মানসম্মত হেলমেটের ব্যবহার, শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন নিশ্চিত করা ইত্যাদি সংশোধিত আইনে অন্তর্ভূক্ত করা একান্ত জরুরী।

আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, প্রায় প্রত্যেক বাসচালক যেন রাস্তায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কেউ কাউকে বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। মহাসড়কে যত দূর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৮০ ভাগ ঘটে চালকদের বেপরোয়া ও খামখেয়ালি গাড়ি চালানোর কারণে। মহাসড়কে একই মানের গাড়ি কাজেই একটি গাড়ির আরেকটি ওভারটেক করার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। অথচ আমরা দেখতে পাই পেছনের গাড়ি সামনের গাড়িটিকে ওভারটেক না করা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায় না। চালকদের এটা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যতদিন এ প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সড়কে দূর্ঘটনা কমবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বে সড়কে প্রতি বছর প্রায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন এর মধ্যে অ-প্রাণঘাতী জখম থাকে। শহরের ভিতরে বড় বড় রাস্তা এবং পথচারী বহুল এলাকাগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। ৮০টির বেশি বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

গাড়ির গতি ঘণ্টায় এক কিলোমিটার বৃদ্ধি পাইলে ৪-৫% দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যানবাহনের গতি যত বেশি কম হবে, পথচারীদের জন্য আহত ও মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি কম হবে। ৩০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯%। ৫০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০%। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর রাস্তায় প্রতি ৩ জনের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয় গতির কারণে।

“সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮”এর ধারা ৪৪-এ মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান আইনে রয়েছে যে কর্তৃপক্ষ, সড়ক বা মহাসড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সহিত পরামর্শক্রমে, বিভিন্ন শ্রেণীর সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ বা পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে। কোন মোটরযানের চালক সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত গতিতে বা বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালাতে পারবে না। কোনো মোটরযান চালক সড়ক বা মহাসড়কে বিপদজনকভাবে বা অননুমোদিতভাবে ওভারটেকিং করতে পারবে না বা মোটরযান চলাচলে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

যে কোন আইন স্পষ্টভাবে প্রধান সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আইনের ধারা ৪৪-এর কিছুটা সংশোধনী এই বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে পারে। যেমন; ধারা ৪৪ সংশোধন করে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত নিম্মে বর্ণিত গতিসীমার বাইরে মোটরযান চালনা বা অন্য কাউকে চালানোর অনুমতি প্রদান করবে না। শহরের রাস্তায় গতিসীমা সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। মহাসড়কে গণপরিবহন, হালকা মোটরযান এবং মোটরসাইকেলের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। মহাসড়কে ট্রাক এবং পণ্য পরিবহনের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। অধিক জনবহুল এলাকা বা যেখানে বেশিসংখ্যক পথচারী চলাচল করে এমন এলাকায় সবধরনের মোটরযানের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।

এছাড়াও কর্তৃপক্ষ যানবাহন এবং রাস্তার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীর মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা নিদিষ্ট করে দিতে পারে। গাড়িচালকদের অবশ্যই তাদের যানবাহনগুলো ধীরে চালাতে হবে যাতে তারা রাস্তায় নিরাপদে থামতে পারে। যেমন-সড়কে কোন বাধা বা বিপদ সম্বলিত সতর্কতামূলক ট্রাফিক চিহ্ন থাকবে; যে সব সড়কে সীমিত দৃশ্যমানতা হবে; সড়কের উপর রেলওয়ে ক্রসিং থাকবে; সেতু/কালভার্ট ও সংযোগ সড়ক থাকবে; ঢালু ও বাঁক বা আঁকা বাঁকা সড়ক থাকবে; সরু ও এবড়ো-থেবড়ো সড়ক থাকবে; যে সব রাস্তায় প্রাণী চলাচল করে বা রাস্তার ধারে তাদের চারণভূমি থাকলে এসকল সড়কে নিরাপদে থামতে পারে।

এছাড়া আইনের অন্যান্য গ্যাপগুলো সামান্য পরিবর্তন করলেই দেশের সড়কে দূর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। যেমন-ধারা ৪৯-এর দিত্বীয় অংশের উপ-ধারা (খ)-এ কার্যকারী ও মানসম্মত সিটবেল্ট এর সংযোজন করা। প্রতিটি যানবাহনের চালকসহ প্রত্যেক যাত্রীর জন্য একটি সিটবেল্ট-এর ব্যবস্থা ও এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

ধারা ৪৯-এর প্রথম অংশের উপ-ধারা (চ) এর জন্য মোটরসাইকেল চালক, মোটরসাইকেলের যাত্রী এবং হেলমেট ব্যবহার বিষয়ে বিশ্বের সেরা অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে কিছু ধারা অর্ন্তভূক্ত করা। যেমন, কোন চালক মোটরসাইকেলে একাধিক যাত্রী বহন করতে পারবে না, বিএসটিআই অনুমোদিত হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ধারা ৪৯-এর প্রথম অংশে একটি নতুন উপ-ধারা সংযুক্ত করা প্রয়োজন। একজন বয়স্ক ব্যক্তির সিটবেল্ট কোন শিশুকে সুরক্ষা দেয় না । শিশুদের দূর্বল অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য উপযুক্ত আসন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সর্বোত্তম সুরক্ষা প্রদান করতে হবে ।

বর্তমান আইনে ধারা ৪৯-এর প্রথম অংশের উপ-ধারা (ক)-এ বলা আছে, অ্যালকোহল বা মদ্যপান করে বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন চালক মাটরযান চালাতে পারবেন না। তবে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। তাই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান (যেমন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা পরামর্শ অনুযায়ী মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের মাত্রা পরীক্ষণ পদ্ধতি) অর্ন্তভূক্ত করা। কারণ মদ্যপান করে গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর ফলে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
###
(লেখক : অ্যাডভোকেসী অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন)

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ৬ জুলাই ২০২১ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দরকার গতি নিয়ন্ত্রণ"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*