সাকিলা পারভীন # গত ৯ জুলাই সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নে সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা তাহমিনা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মাত্র দুই মাস বয়সী শিশু করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে (শিশু)। এই করোনাকালেই যমজ সন্তানের জন্ম দিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকেই না ফেরার দেশে যেতে হলো ৭১ টেলিভিশনের একজন কর্মকর্তাকে। চলমান মহামারীকালে প্রতিনিয়ত এমন অনাকঙ্খিত মৃত্যুর খবরে যেমন বাতাস ভারী হচ্ছে, অন্যদিকে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ ও শিশু জন্মের তালিকাও একেবারে ছোট নয়।
আবার লকডাউন, হোম অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ এমন কিছু বিষয় বিবেচনায় সন্তান জন্মদানের এটাই সঠিক সময় ধরে নিচ্ছে অনেক উচ্চ শিক্ষিত পরিবার। প্রসূতি বা নবজাতক মৃত্যুহার কমানো কিংবা অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানো এসব ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বৈশ্বিক মহামারী। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে করোনাকালকে বিবেচনায় নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরির আহ্বান বিশেষজ্ঞ মহলের। এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম বছরের তুলনায় এবারে আক্রান্ত এবং মৃত্যু হার কয়েকগুন বেশি। ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক ভারতীয় ভেরিয়েন্ট। চলছে টানা তৃতীয় সপ্তাহের মতো লকডাউন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবস্থা রাজধানীর থেকে বেশি সংকটাপন্ন। মোটকথা ভীষণ সংকটময় একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাড়তি সংক্রমণ আর অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপন করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের অন্যতম আহ্বানগুলো ছিলো- কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বন্ধ করতে হবে বাল্যবিয়ে এবং অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। এমনকি এই মহামারীকালে মা ও নবজাতকের উচ্চঝুঁকি আশংকায় গর্ভধারণে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছর ২০২০ সালের মার্চের শুরুতেই আমাদের দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। তখন থেকেই করোনা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাসহ সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা চরম ব্যহত হয়েছে। শুরুতে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক যেমন বন্ধ হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে হঠাৎ তৈরি হওয়া মহামারী পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় খুবই স্বপ্ল সংখ্যক চিকিৎসক অতিরিক্ত মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মিলিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ- আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় কোভিড-১৯ এর কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বৃদ্ধি ও আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এরফলে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। ফলশ্রুতিতে অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএফপিএ। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় দুই লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বৈশ্বিক মহামারী শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিক প্রতিবেদনে এই সময়ে সারা বিশ্বে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের ফলে জনসংখ্যার বুম, বাল্যবিয়ে, মাতৃমৃত্যু হার বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু আশংকা প্রকাশ করেছিলো। ইউনিসেফ-এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আশংকা সত্যি প্রমাণিত হয়। এই বছরের শুরুতেই ইউনিসেফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২১ সালের প্রথম দিনে জন্ম নিয়েছে ৯ হাজার ২৩৬ শিশু। আর বিশ্বজুড়ে প্রথম দিনে ভূমিষ্ট হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৫০৪ শিশু। এবছর গোটা বিশ্বে ১৪ কোটি শিশু জন্ম নিতে পারে। আর আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নেয়। সেই হিসাবে গত পহেলা জানুয়ারি প্রায় এক হাজার শিশু বেশি জন্মগ্রহণ করেছে বলে ইউনিসেফের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রনে কাঙ্খিত সাফল্য, মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যু হার কমানো, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা রোধ ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএফপিএর মতে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোভিড-১৯ বাধা সৃষ্টি করছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘করোনার প্রথম দফায় আমাদের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এরই মধ্যে এর নেতিবাচক কিছু প্রভাব পড়েছে। তবে এ কারণে জন্মহার ঠিক কত শতাংশ বেড়েছে সেটা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলামের মতে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সকলের সম্পৃক্ততায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন স্বাস্থ্য সেবার আওতা বাড়াতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এখনই। করোনাকালে সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহ বিঘিœত হয়েছে। বর্তমান সময় বিবেচনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে আ্যপভিত্তিক সেবার গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার বৃদ্ধি করে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সুখী পরিবার নামক কল সেন্টার ১৬৭৬৭ কল করে সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে গ্রামীণ নারীদের আগ্রহী করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আ্যপভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও দক্ষ করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি ও কমিউনেশন বিভাগের প্রধান মনজুন নাহার বলেন, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় অধিকাংশ দুর্যোগ পরবর্তী এটি একটি সাধারণ প্রবণতা বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সেকারনেই করোনা মহামারীর প্রথম দুই-তিন মাস পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিলেও, পরবর্তীতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সহযোগিতায় মেরী স্টোপস বাংলাদেশের নিরাপদ মাতৃত্ব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারসহ এসংক্রান্ত যাবতীয় কর্মসূচী এবং তথ্যসেবা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে।
উন্নয়ন বিশ্লেষক সৈয়দ মাহাবুবুল আলম বলেন, মহামারী দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এর প্রভাবে অর্থনৈতি সংকট আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ দ্রুত নিতে হবে। তা নাহলে, বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে আমাদের সকল উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। এই সংকট মোকাবেলায় খুবই দ্রুত পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং সেই অনুযায়ী সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহনের আহ্বান জানান তিনি।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১১ জুলাই ২০২১ ইং
Be the first to comment on "জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ করোনা পরিস্থিতি"