সাকিলা পারভীন # উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে নির্মিত ‘স্বয়ংক্রিয় সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ চালু না হতেই অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে লবণাক্ত এই অঞ্চলের দুঃস্থ ও হতদরিদ্র মানুষের সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মনিটারিং জোরদারের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির পরিমাণ দিনে দিনে কমছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় প্রায় ৭০ লাখের বেশি মানুষ এখন খাওয়ার উপযোগী পানির তীব্র সংকটে ভূগছেন। ধীরে ধীরে এ সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাবার পানি চরম সংকট দেখা দেওয়ায় এখারকার নারীদের প্রতিদিন প্রায় ৩-৬ ঘন্টা ব্যয় করে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কৃষিতে দক্ষ এ সকল নারীরা দিনের একটি বড় অংশ খাবার পানি সংগ্রহে ব্যয় করায় দেশের অর্থনৈতিক খাত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অনেক সময় পারিবারকে বেশি সময় দেওয়াতে নারীরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বেশকিছু প্রকল্প নেওয়া হয়।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য বাগেরহাট জেলার দুঃস্থ ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ’ প্রকল্পের আওতায় ৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের আওতায় বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে ২০২টি ‘স্বয়ংক্রিয় সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ নির্মাণের কথা থাকলেও সবগুলো ইউনিট এখনো শেষ হয়নি। কাজ শেষ না হতেই প্রকল্পের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসের দিকে বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নে প্রথম পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়েই ১৫টি ইউনিট নির্মাণ করা হয়। উপকারভোগীদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া এবং নি¤œমান সামগ্রী দিয়ে দায়সারা ভাবে প্রকল্পের কাজ শুরু করার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের দেখার নির্দেশ দেন ওই আসনের সংসদ সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। এরপর সেই ১৫টি ইউনিট ভেঙ্গে আবার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রকল্প মেয়াদকালে (২০২০ সালের ডিসেম্বর) মোংলায় ১৩৫টির মধ্যে ৪৪টি এবং রামপালে ৬৭টির মধ্যে ২৬টি ইউনিট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্ত নির্মাণের পর পরই এর বেশির ভাগ ইউনিট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন-২ শাখার পত্রে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন এলাকায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে অনুমোদিত প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট তথ্য সম্বলিত দৃশ্যমান সাইনবোর্ড স্থাপন করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ দেখভালের দায়িত্বে এলাকায় তেমন কাউকে দেখা মেলেনি। সেখানে সোলার প্যানেল বসানো হলেও তা কোন কাজে আসছে না। স্থানীয় পুকুর দিয়ে পানি এনে বড় পানির ট্যাকিংতে রাখার সিস্টেম করা হলেও পানি তোলার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পানির প্লান্ট তৈরি করার পরপরই নষ্ট হয়ে গেছে। নির্মাণের ১০দিন পর থেকে এই প্লান্ট থেকে কেউ একফোঁটাও পানি নিতে পারছে না। কোথায় কি সমস্যা হয়েছে তা দেখারও কেউ নেই। তারা জানান, কোন ভাবে প্রকল্পের কাজ শেষ করেই সংশ্লিষ্ট কেটে পড়েছে। তাছাড়া ঝড়-বন্যা কবলিত ওই এলাকায় কোন রকমে দায়সারা ভাবে যে পানির প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে তা সামান্য ঝড় এলেই আকাশে উড়ে যাবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ওই প্রকল্পের পরিচালক শুভাশীষ সাহা পার্লামেন্টনিউজবিডি.কমকে জানান, করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তিনি দুইবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও কিছু কিছু অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়ার পর সমাধান করা হবে।
এমতাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফা-ের প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মনিটারিং জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন নেটওয়ার্ক অন কাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ (এনসিসি’বি)’র প্রকল্প ব্যবস্থাপক (রিসার্চ এন্ড এ্যাডভোকেসি) ড. মুহাম্মদ ফররুখ রহমান। তিনি বলেন, অতীতে প্রকল্পগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে জলবায়ু ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। আবার গৃহীত প্রকল্পগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। তাই প্রতিবছর জিডিপি’র কমপক্ষে এক শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বরাদ্দ করতে হবে। জলবায়ু বাজেটের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন খাতে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন তিনি।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১২ জুলাই ২০২১ ইং
Be the first to comment on "জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ডের প্রকল্প : অকেজো হয়ে পড়ছে অধিকাংশ পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট"