সাকিলা পারভীন:
“আমরা কন্যাশিশু- প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হবো, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বো।” প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস ২০২১। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অংশগ্রহনে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবস উপলক্ষ্যে দেশের বিশিষ্টজনরা কন্যাশিশুদের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন।
যদিও যাদের জন্য এতো আয়োজন সেই কন্যাশিশুরা ভালো নেই এই বৈশি^ক মহামারীর প্রকোপের মধ্যে। করোনা মহামারীর প্রভাবে পরিবারে কর্মহীনতা, আর্থিক সংকট, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ নানাবিধ সংকট। পরিবারের যেকোন সংকটের প্রথম শিকার বা ভূক্তভোগী হতে হয় কন্যাশিশুটিকে। করোনা মহামারীকালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেকারণেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি অপরাধের অধিকাংশই সংঘটিত হচ্ছে কন্যাশিশুদের সাথে। তবে আশার কথা হচ্ছে- ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে আমাদের কন্যাশিশুরাও। বাল্য বিয়ের শিকার হতে যাওয়া কন্যাশিশুটি নিজেই বিয়ে বন্ধের জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার একাধিক খবর আমাদের আশান্বিত করে। আমাদের কন্যারা অন্যায়কে রুখে দিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে।
নানান খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে মেয়েদের অপ্রাপ্ত বয়সে বা বাল্য বিয়ে দেয়া আমাদের সমাজের বেশ পুরোনো ব্যাধি। দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের নিরলস প্রচেষ্টায় বাল্য বিয়ের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসলেও করোনাকালে দেশের হাজারো কন্যাশিশুর জীবনে নেমে এসেছে বাল্যবিয়ের মতো অভিশাপ। করোনাকালে দরিদ্র পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট তৈরির সাথে সাথেই সর্বপ্রথমে চোখ পড়ে গিয়ে কন্যাশিশুটির উপর। সেই যেন সব বাড়তি খরচ করছে। মেয়েটিকে বিদায় করতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন দরিদ্র বাবা-মা। আর সেকারণেই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরাও।
গত ২০১৯ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে সেই সময় মাত্র ৮ মাসে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫০৬ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল। আর করোনাকালে দীর্ঘদিন টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় একই উপজেলার প্রাথমিক স্তরের প্রায় ১৬ জন শিক্ষার্থীকে বিয়ে দিয়েছে তাদের পরিবার। তাদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির তিনজন এবং পঞ্চম শ্রেণির ১৩ জনের বিয়ে হয়েছে। বাল্য বিয়ের শিকার এসব শিশুদের পরিবার এবং এলাকাবাসী বাল্য বিয়ের কারণ হিসেবে আর্থিক অনটন, অসচেতনতা, কুসংস্কার, আত্মীয়-স্বজনসহ আশপাশের মানুষের চাপ এমনকি সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকেও দায়ী করছেন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, বৈশি^ক মহামারীকালে এবিষয়ে কিছু ভার্চুয়াল সভা করা গেলেও স্বাভাবিক সময়ের মতো সরাসরি উঠান বৈঠক বাব বিভিন্ন পরামর্শ সভাগুলো করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে আমরা বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলাম বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
ইউনিসেফের তথ্য মতে, দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই, আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে, যা দুই দশক ধরে এই হার অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্ব নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গার্ল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বাল্যবিয়েকে শুন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীর বাল্যবিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন।
গত বছর ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্ল্যান বাংলাদেশের সহায়তায় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় বাল্যবিয়ে নিয়ে জরিপ চালায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন সাত মাসে দেশের ২১ জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ৫০.৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ এবং ১.৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভের প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাল্যবিয়ের ফলে ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের মধ্যে ৩৪.২ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এদিকে সংবাদ মাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। অকাল গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনে নিজেদের অনিরাপদ মনে করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, গত বছর শিশু অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। শিশু হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানি, সরকারি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো বছরজুড়ে অব্যাহত থেকেছে। ওই বছর শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৫৮৯ শিশু। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮৮। এ ছাড়া ২০২০ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৭১৮ শিশু। সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫০ জন শিশু, যার অধিকাংশই কন্যাশিশু। এ সময়ে ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৫৮৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১৪৪টি। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১ জনকে। ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনকে এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে আটজন।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশুদের উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। যাদের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ হচ্ছে কন্যাশিশু। এই কন্যাশিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরকে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০০ সালে। এর প্রায় একদশক পর ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উদযাপনের প্রস্তাব উত্থাপিত। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। এই হিসেবে কন্যাশিশু দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রথম বলা যায়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টিম এসোসিয়েট-এর টিম লিডার পুলক রাহা জানান, করোনাকালে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ইত্যাদি জরুরি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়েছে। তিনি যেকোন সংকটকালে নারী ও শিশু বিশেষ করে কন্যাশিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানান এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতি। একই সাথে কন্যাশিশুদের জন্য সকল বৈষম্য-বঞ্চনা মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
করোনাকালে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দীর্ঘদিন এই বিষয়ে কর্মরত সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, অধিকাংশ পরিবারে কন্যাশিশুরা খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ এমনকি সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হতে দেখা যায়। দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু অধিকার আইন-নীতিমালা ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও অঞ্চলভেদে বৈষম্য রয়েছে। আর করোনা মহামারি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের প্রভাবে কন্যাশিশুদের জীবনে দেখা দিয়েছে বাল্যবিয়েসহ নানামূখী সংকট।
প্রায় তিন দশকের বেশি সময় নারী-শিশু তথা মানবাধিকার বিষয়ে কর্মরত জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলির মতে, কন্যাশিশুর সমতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি পরিবার থেকেই নিশ্চিত করতে হবে। আর যে যাই বলুক না কেনো- তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কাউকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। আর নারী কিংবা কন্যাশিশুদের পিছিয়ে রেখে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব হবে না। সেকারণে পরিবার থেকেই কন্যাশিশুদেরকে সম্পদ ভেবে তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরণের সহযোগিতা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তাহলেই সফলতা পাবে জাতীয় কন্যাশিশু দিবসের সকল আয়োজন।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম/ ৩০ সেপ্টেম্বও ২০২১ইং।
কন্যাশিশু বোঝা নয়॥ওরাই গড়বে প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ
শেয়ার করতে ক্লিক করুন
Be the first to comment on "কন্যাশিশু বোঝা নয়॥ওরাই গড়বে প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ"