সর্বশেষ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস : নোনা পানির আগ্রাসনের শিকার নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য

সাকিলা পারভীন # রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিং-এর বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করেন ৩৮ বছর বয়সী ছফুরা বেগম। দুই বছর আগেও সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নওয়াবেকী গ্রামে তার সুখের সংসার ছিলো। কোন সন্তান না থাকলেও স্বামীর সঙ্গে ভালোই কাটছিলো। কিন্তু চার বছর আগে জরায়ু রোগে আক্রান্ত হন। ক্যাান্সারের হাত থেকে বাঁচতে জরায়ু কেটে ফেলতে হয়। এরপর দিনমজুর স্বামী তাকে ফেলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। আর কাজের সন্ধানে ছফুরা চলে আসে ঢাকায়।

এমন গল্প উপকূলীয় অঞ্চলের সকল গ্রামেই পাওয়া যাবে। নোনা পানির আগ্রাসনের কারণে সেখানকার নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততাপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে।

‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততা প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহূত কাপড় ধুয়ে আবারো সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত, ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন। যা উপকূলের নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়নে বড় বাধা বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এমতাবস্থায় আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’। এই মূল প্রতিপাদ্যের আলোকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নে জেণ্ডার সমতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উপকূলের নারীদের সমতা দুরের কথা, এখনো স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে নারী স্বাস্থ্যর উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।

গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা নাহলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটা। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে নারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয়।

শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়। লবণাক্ততার কারণে ফসল হয় না। কাজের খোঁজে পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা রয়ে যায় সন্তান, বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্বে। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। পুরুষ না থাকায় নিরাপত্তাহীনতাও তার। অরক্ষিত জীবন। তারপর হয়তো কখনও গ্রামও ছাড়তে হয়। শহরে বস্তিতে এসে ইটভাটা আর পোশাক কারখানার শ্রমিক হতে হয়।

উপকূলীয় জেলা খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় ফলে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে। এছাড়া নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষি কাজ, গবাদিপশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয়।

সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে সুপেয় পানি এবং টেকসই জীবন-জীবিকার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। উপকূলীয় এলাকায় নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ‘সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)’ চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। উপকূলের নারীদের এই ঝুঁকিতে রেখে কিভাবে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব।

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছে বেসরকারী সংস্থা ‘টিম এসোসিয়েট’। সংস্থাটির টিম লিডার পুলক রাহা বলেন, নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হবো। কারণ নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীল তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান। তাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়ে উপকূলের নারীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নিতে হবে।

সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা মোকাবিলা ও নারীদের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকা সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ। তিনি বলেন, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন বা সহনশীলতার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি (জানুয়ারি-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এছাড়া উপকূলে নারী স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন, নারী সংবেদনশীল সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থা গড়ে তোলার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
###

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ৮ মার্চ ২০২২ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "আন্তর্জাতিক নারী দিবস : নোনা পানির আগ্রাসনের শিকার নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*