সর্বশেষ

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনলাইন সেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি

সাকিলা পারভীন:
গত প্রায় আড়াই বছর বৈশ্বিক মহামারীকালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এবং শিশু জন্মের হার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা বিশ্বের প্রতি মিনিটে জন্ম নেওয়া আড়াইশ’ শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে ১০টি। বিশেষ জরুরি অবস্থাসহ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞমহল। তাদের মতে, বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় অনলাইন সেবার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মধ্যে বিশেষ সচেতনতা তৈরিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরি।

এই অবস্থায় প্রতি বছরের মতো আজ ১১ জুলাই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘৮০০ কোটির পৃথিবী ; সকলের সুযোগ, পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করে প্রাণবন্ত ভবিষ্যৎ গড়ি।’ বৈশ্বিক মহামারীকালে অনাকাঙ্খিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি বিবেচনায় এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ বৈশ্বিক মহামারি শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিক প্রতিবেদনে এই সময়ে সারাবিশ্বে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু আশংকা প্রকাশ করা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাল্যবিয়ের ঘটনাও বেড়ে যাবে বলে আশংকা করা হয়। গত আড়াই বছরে যার সত্যতা মিলেছে। যা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশে^ প্রতি মিনিটে জন্ম নেওয়া ২৫০ জন মধ্যে ১০ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই কোটি। ১৯৪১ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৪ কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ ৮১ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র দুই কোটি ২০ লাখ। আবার ১৯৬১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ, যা ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি লাখে। অর্থাৎ ৩০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৭ লাখ। ২০১৬ সালের জুলাইতে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৮ লাখ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ এক হাজার। সে হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটি ২৫ লাখে। যা জন্মনিয়ন্ত্রণে কাঙ্খিত সাফল্য, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু হার কমানো, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা রোধ ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বাাঁধাগ্রস্থ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম বলেন, এই অবস্থায় জনসচেতনতা সৃষ্টিই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি আরও বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। একইসাথে অনলাইনে স্বাস্থ্য সেবার আওতা বাড়াতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী হওয়ায় সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহের পরিবর্তে অ্যাপভিত্তিক সেবা বাড়াতে হবে। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই মোবাইলের ব্যবহার বৃদ্ধি করে ডিজিটাল সেবা প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নিতে হবে।

করোনা পরিস্থিতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে বাঁধাগ্রস্থ করেছে উল্লেখ করে উন্নয়ন সংস্থা ‘টিম এসোসিয়েট’-এর টিম লিডার পুলক রাহা বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় এখনই যথাযথ উদ্যোগ না নিলে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাধাগ্রস্থ হবে সকল উন্নয়ন। তাই সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে আ্যপভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা অর্জনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ‘সুখী পরিবার’ নামক কল সেন্টার ‘১৬৭৬৭’ নম্বরে কল দিয়ে সরাসরি চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে গ্রামীণ নারীদের আগ্রহী করে তুলতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।

ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একযোগে বলছে, করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা কোভিডের কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে। যার ফলে ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। এক দশমিক ৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার বঞ্চিত হয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
একাধিক বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়স নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। এই বয়সে তারা প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে তেমন সচেতন থাকে না। এই অবস্থার কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত হন। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ন। আর মেয়েদের ১১ শতাংশই অনেক বেশি রোগা-পাতলা। তাদের অধিকাংশেরই জিংক, আয়োডিন ও আয়রণের মতো পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া ও অল্প বয়সে গর্ভধারণের কারণে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েরা অপুষ্টিতে ভূগছেন।

এ বিষয়ে মেরী স্টোপস-বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি বিভাগের প্রধান মনজুন নাহার দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে মারাত্মক ভাবে বাধাগ্রস্থ করেছে। অধিকাংশ দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে এটি একটি সাধারণ প্রবণতাও। তিনি আরো বলেন, করোনা মহামারির প্রথম দুই-তিন মাস পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিলেও, পরবর্তীতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সহযোগিতায় মেরী স্টোপস নিরাপদ মাতৃত্ব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারসহ এসংক্রান্ত যাবতীয় সেবা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে। তবে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাকে আরও কার্যকরী এবং সফলতা অর্জনে সকলে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি জানান।
###

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১১ জুলাই ২০২২ইং।

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনলাইন সেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*