ফাতিমা কাজল # জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি ঘোষণাপত্র বা আন্তর্জাতিক দলিল, যা সমস্ত মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে সংহত করে। এলিয়ানর রুজভেল্টের সভাপতিত্বে জাতিসংঘের একটি কমিটি কর্তৃক খসড়া তৈরি করা হয়। এটি ফ্রান্সের প্যারিসের প্যালেস দে শ্যালোটে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশন চলাকালে প্রস্তাব ২১৭ হিসাবে গৃহীত হয়। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে না। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার হাতে বিচার বহির্ভূত ও বেআইনি হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও বেআইনিভাবে আটক রাখা, দুর্নীতি, এবং মত প্রকাশে বাধাদানের মতো ইস্যুগুলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সাংবাদিকদের উপর শারীরিক হামলা, হয়রানি, বা ভয় দেখানোর মতো কাজ করেছে। এই আইনকে মানবাধিকার কর্মীরা-সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হলেও নির্বিচার ও বেআইনিভাবে হত্যার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ১৯৬টি বিচার-বহির্ভূত হত্যা হয়েছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ১৮ সালে ছিল ৪৬৬টি।
মতপ্রকাশ করে যখন কোন সাংবাদিক বা সাধারণ জনগণ তার কথা বলতে চায় তখনই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তাকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সংবিধানের মানবাধিকার আইনে জনগণের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘সবচেয়ে বড় খড়গ’ বলছেন তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল।
২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আইনটি প্রণয়নের সময় সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন, ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ দমন করত বিশেষ করে গুজব ও মিথ্যা অপপ্রচার বন্ধ করতেই এই আইন করা হয়েছে। এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোন আইন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় উল্টো চিত্র। আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্যমতে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের জেরে গত বছরের প্রথম ১১ মাসে ৬০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের হয়। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলাদায়ের হয়।
আবার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়। এরমধ্যে, সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করে, ক্ষমতাসীন কোন সংগঠনের নেতা-কর্মী সমর্থক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল।
এ নিয়ে ফারুক ফয়সাল বলেন, সাংবাদিকদের মেরে যদি ছাদ থেকে ফেলা দেওয়া হয়, রাতের বেলা সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায়, ২০ ঘণ্টা খবর থাকে না। তখন সেই দেশের সাংবাদিকতার নিরাপত্তা তো প্রশ্নের মুখে পড়বেই। এভাবে তো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে উন্নতি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এই আইনের মাধ্যমে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে বলে মনে করেন মি. ফয়সাল। তার মতে, আইনের অনেক ধারা বেশ অস্পষ্ট। একজনের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ উঠলে, ওই ব্যক্তি ছাড়া আরো ১৪ জন মামলা ঠুকে দেয়। এই প্রবণতা চলতে থাকলে আগামী দিনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার আরও অবনতি ঘটবে এবং স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিডিয়ার মালিকানার বিষয়ে ড. সাইমুম পারভেজ বলেন, বেশিরভাগ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রায় সবগুলো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকানাই বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে। যাদের নানামুখী অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে।
সমাজের সব স্তরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের এই বিস্তার আগে দেখা যায়নি, গত এক দশকে (২০১৩-২০২২) এটি নতুন একটি প্রবণতা। একদিকে যেমন ব্যক্তি-পর্যায়ে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে, আরেকদিকে ব্যক্তি-পর্যায়ে নিপীড়ক তৈরি হয়েছে। নিপীড়িত ও নিপীড়ক উভয়ের সমাজে সব ক্ষেত্রে বিস্তার হয়েছে। বহুদিন আগেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিস্তৃত ও আগের চেয়ে সংখ্যা ও কাঠামোগত দিক দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে সেলফ-সেন্সরশিপ তৈরি হচ্ছে। যা সংবিধান নির্দেশিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করছে। এই বাধা অপসারণে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ইং
Be the first to comment on "মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সংবিধানেই"