সর্বশেষ

গল্প : কুদরতের কুদরতি

# তারিক মাহমুদ #

‘মা একটু গরম চা দেতো। লেবু আর আদা মিশিয়ে দিস।’
চট করে গরম চা নিয়ে অহনা হাজির।
‘এতো জলদি নিয়ে আসলি! লেবুর রস আর আদা দিয়েছিস্ তো?’
‘হুম। সব দিয়েছি। গরম পানি ফ্লাস্কে রেখেছি। শুধু চা-পাতা মেশানো আর লেবু-আদা। এইতো দু’মিনিটের ব্যাপার।’

‘তোরাও দিনে তিন থেকে চার বার চা পান কর। এতে অনেক উপকার হবে। যেভাবে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। বাড়িতে বসেই যার যার ব্যবস্থা তাকে করতে হবে। শুনেছি ভাইরাস প্রথমে গলায় অবস্থান করে, পরে ফুসফসে যায়। তাই গরম জল পানে গলায় অবস্থানকালেই ভাইরাসকে নির্মূল করা সম্ভব। আতংকিত হয়ে আর কি হবে? সতর্কতার সাথে দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন উত্তম কাজ। চীনের উহান রাজ্যে হাসপাতালে রোগীদের কিছুক্ষণ পরপর চা পান করিয়েছে। যে কারণে চীনে দ্রুতই ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধ করা গেছে। আবার মৃত্যুও তুলনামূলক কম হয়েছে।’

‘আচ্ছা বাবা, বিশ্বজুড়ে এমন তান্ডব আর কখনো কি হয়েছে? আর এ ভাইরাসের সংক্রমণও বেশ মারাত্মক। তাছাড়া ঐ যে শুনি কত পীর, কবিরাজ তারাও তো কিছু করতে পারছেন না। এমনকি বড় বড় বিজ্ঞানী, ডাক্তারও তো এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। চিন্তা করে তো কুলকিনারা পাচ্ছি না বাবা।

বাবা, কুদরত চাচা কি বলে এ ভাইরাস নিয়ে কিছু জানতে চেয়েছ?’

‘আরে মা, পৃথিবীর গোটা সীমান্ত সব লকডাউন হয়ে গেছে। জল, স্থল, আকাশে বলতে গেলে সকল যোগাযোগইতো অচল হয়ে গেছে। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই তো বন্ধ। গোটা বিশ্বে এরূপ পরিস্থিতি আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি। তবে, প্ল্যাগ, কুষ্ঠ, কলেরা এ সকল রোগে অঞ্চলভেদে পূর্বে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তখন পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থাও এতো বিস্তৃত ছিল না। ছিলনা ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট কিংবা আজকের মতো মিডিয়া। আর, তোর কুদরত চাচাও করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আক্রমণ করার দিন থেকে উধাও। যাই হোক, বাড়িতে আসলি- আস্তে ধীরে সব আলাপই হবে।’

আনসার সরদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষে অবসর জীবন যাপন করছেন নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের চানপুর গ্রামে। একমাত্র কন্যা অহনা ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনসার সরদার চাকুরী জীবন শেষে নিজ বাড়িতে পৈত্রিক জমি-জমা আর তিন চারটা পুকুর নিয়ে সময় কাটান। সূফীবাদের চর্চা করেন। এছাড়া দরবারি জীবন যাপন করেন। স্ত্রী আয়েশাও স্বামীর সাথে দরবারি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে অহনা এসেছে গ্রামের বাড়ি। এখনো বিয়ে করেনি। লম্বা চওড়া রূপ-গুণের অধিকারী অহনাও বাবার মতবাদ চর্চায় ব্যস্ত। সেকারণে সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত হয়েই বিবাহের প্রতি তার আপাতত অনিহা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে গণিতে অনার্স মাস্টার্স। আর ফলাফল ঘোষণার পরপরই সরকারি চাকুরী। স্বাধীনচেতা অহনা নাচ, গান, নাটকেও পারদর্শী। অহনার পিতাও গান আর নাটকে পটু ছিলেন। তাছাড়া পিতা আনসার সরদার লিখেছেন অসংখ্য কবিতা আর বেশকিছু উপন্যাস। অহনা সময় পেলেই মনযোগ দিয়ে পড়ে পিতার উপন্যাসগুলো।

ছুটিতে বাড়িতে এসে অহনার সময় কাটছে না। তাদের দরবার বাড়িতে অসংখ্য লোকের যাতায়াত। আপাতত করোনা ভাইরাসের কারণে সে সকল লোকের আগমনেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। কাছেই সূফী সাধক আনোয়ারুল হকের সমাধি। এর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীনের সমাধি।

পিতা আনসার সরদারের খুবই কাছের বন্ধু কুদরত সরকার।
‘অহনা, কোথায় গেলি তুই?’
ঘরের ভেতর থেকে স্ত্রী আয়েশা বের হয়ে এলেন। ‘কি হয়েছে? মেয়েটা কি একটুও নিজের কাজ করবে না? সারাক্ষণই ডাকছো আর ফুট ফরমাস নানারকম।’
‘না-মানে এতোদিন পর আজ এলো। ভাবছি ওর সাথে গল্প করি। জানো, স্মৃতির পাতায় কতো কথা, কতো গল্প।’
‘হয়েছে, হয়েছে। গল্প করবে ক্ষণ। অহনা চানপুর শরীফে গেছে বাবা আনোয়ারুল হক (আনার বাবা) এর মাজার জিয়ারত করতে।’

‘ওহ! তা বলবেতো। মা আমার আধুনিকতা আর অতিবিজ্ঞানে নিজেকে বিকিয়ে দেয়নি। জেনে রেখো- ও ঠিকই আল্লাহ’র দুনিয়াটায় সম্পৃক্ত থাকবে। মানুষের পাশে থাকবে। এটা আমার পরম পাওয়া, পরম শান্তি। জানো- আমার গুরু বাবা বলতেন, “নিজের বিচার নিজে কর রাত্রদিনে।” আবার আমার আরেক বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ বলতেন, “সত্য মানুষ হোন- দেশ ও জাতির কল্যাণ হবেই হবে”। এই উভয় সাধকই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সাধনার শক্তিতে। আর হানিফতো আমিসহ যুদ্ধের ময়দানেই ছিলাম। হানিফও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রীধারী। আবার সরকারি চাকুরী শেষে আনার বাবার ভাবশিষ্য হয়ে গেল। ঢাকায় মিরপুরে হানিফের দরবারে গিয়েই পরিচয় হলো আরেক সরকারি চাকুরীজীবী যার সাধক নাম ফকির তারা। কুদরত আর আমি বলতে পারো ফকির তারার বেশ ভক্তই হয়ে গেলাম।’

‘সে সব যা’হোক। শুনতে পাচ্ছি করোনা ভাইরাস ঢাকায় বেশ সংক্রমিত হয়েছে। আর এখন নাকি গ্রামে-গঞ্জে ধীরে ধীরে ধেয়ে আসছে। আর কুদরত ভাইও যে কোথায় হারিয়ে গেল? মোবাইলও ধরছে না- কেবল ক্ষুদেবার্তায় জানাচ্ছে চিন্তা না করতে।’
‘শোন, কুদরত কে তা’তো জানো। তাকে নিয়ে আর ঐ যে ফকির তারাকে নিয়ে যে উপন্যাস লিখেছি তা’তো পড়েছ। তাই কুদরতকে নিয়ে ভেবো না। সময় হলেই ফিরবে সে।’

‘কি বাবা আমাকে খুঁজেছো?’
‘হুম। মানে তুই এলি এতোদিন পর। তাছাড়া সময়টাও অস্বাভাবিক। ভাবছিলাম গল্প করবো- বলতে পারিস স্মৃতিরোমন্থন।’
‘জানো বাবা, আনার বাবার সমাধি জিয়ারত করলাম। একটা বিষয় ভালো লাগলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ৩১ দফা স্বাস্থ্যবিধি সকলেই মেনে চলছে। নেই কোন অযাচিত ভীড়।’

‘হুম। গুরুজী বলতেন, “লাইগ্যা থাকলে মাইগ্যা খায় না”। কথাটার অর্থ দিন যায় আর নতুন করে উপলব্ধি করি। সত্যি কথা কি- মানুষ তো অজ্ঞ। বুঝতে চায় না। ভাবে যে মাজারে আসলেই সব পাওয়া যাবে। কিন্তু না- গুরুজী বলতেন, “কর্মে নিয়োজিত হও, সৃষ্টিকর্তা সাহায্য করবেন”। সত্যিইতো, দেওয়ার মালিকতো সৃষ্টিকর্তা। সাধককুল ছিলেন মহান সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহপ্রাপ্ত। সেকারণে তাঁদেরকে অনুসরণ করা যায়। তাঁদের দরবারে হাজির হয়ে কর্মের ইবাদত এর ধারণা পাওয়া যায়। তাঁদের জীবন কর্ম, ত্যাগকে স্মরণ করে মহান সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করা যায়- যা গ্রহণ করার মালিক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা, যিনি এক ও অদ্বিতীয়।’

‘ঠিক বলেছ বাবা। কিন্তু অজ্ঞ মানুষ সেই সৃষ্টির আদিকাল হতেই অজ্ঞ। যে কারণে পৃথিবীতে আজ এতো বৈষম্য, শোষণ, অন্যায়, অনাচার।’
‘বাবা, তুমি নাকি দু’একদিন আগে নতুন একটি উপন্যাস লিখেছ। দাও আমাকে- আমি আজ উপন্যাসটা পড়ব।’
‘হুম। উপন্যাস ঠিক না। বলতে পারিস উপলব্ধি বা দর্শন। খুব বেশি দীর্ঘ নয়- অল্প ভাষায় ছোট ছোট কিছু কথা। কুদরতের কুদরতি। এই নে।’

কুদরত সরকার। আমার ছোট্টবেলার পথের সাথী। আমি ডাকি কুদরত নামে। করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আক্রমণ করার দিন থেকেই সে নিখোঁজ। আমি কোন কলও দেইনি মোবাইলে। মোবাইলও সুইচড অফ নয়। আমার স্ত্রীর সাথে ক্ষুদে বার্তায় যোগাযোগ আছে। তবে কোথায় আছে-তা বলছে না। বলেছে চিন্তা না করতে। তবে, আমি জানি সে কোথায় আছে এবং কেন গেছে। আর এসব কিছু আমাকে জানিয়েছে ফকির তারা। তারা দু’জনেই একসাথে একই স্থানে আছে সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফের ডিউটিতে। প্রসঙ্গতঃ সাধক হানিফ বছর খানেক আগে পর্দা করেছেন এ ইহজগৎ হতে।

আমি তখন আমাদের গ্রামের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার পিতা আমাকে প্রায়ই নিয়ে যেতেন সূফী সাধক আবু আলী আক্তারউদ্দীন এর আস্তানায়। এটা কিশোরগঞ্জ জেলার ফরিদপুর গ্রামে। সেখানেই আমার পরিচয় ঘটে কুদরতের সাথে। পিতা-মাতা কিংবা কোন বংশ পরিচয়ই তার ছিল না। ভৈরব রেল স্টেশনে সে হারিয়ে যাওয়ার পর এদিক ওদিক হয়ে এক ফেরিওয়ালার বাড়িতে আশ্রয় নেয় কুদরত। ফরিদপুর গ্রামে বড় হতে থাকে। কুদরত নামটিও রাস্তার মানুষের দেয়া। নিজের প্রচেষ্টায় হাটে বাজারে কাজ করেও পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি হয়। সেও তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। এমনি করে প্রাইমারি আর ম্যাট্রিক পাশ করার পর দু’জনেই আমরা ভর্তি হলাম কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে। সেখান থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচয় হয় আরেক আলোকিত মানুষ শেখ আবদুল হানিফের সাথে যিনি সুফী সাধক আনোয়ারুল হকের ভাবশিষ্য।

এরই মধ্যে আমরা তিনজনই ভক্ত হয়ে উঠি সুফী সাধক আনোয়ারুল হকের। আর যার আস্তানা আমার নিজ গ্রাম চানপুরে। সরকারি চাকুরী ছেড়ে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক প্রবেশ করেন সূফী জগতে। ১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ এর ভাষণের দিন রেসকোর্স ময়দানে আমরা তিনজনই শপথ নেই দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরব না।

দেশ স্বাধীন হলো- বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কুদরত ফিরে গেলো আমার বাড়িতে। শুরু করলো দরবারি জীবন। আর আনার বাবার খেদমত। কখনও কখনও ঢাকার ধানমন্ডিতে আনার বাবার আস্তানায় আবার কখনও চানপুরে।

কুদরত অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিল। তাঁর একটাই কথা-‘আমার জন্য আমার আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট’। যেহেতু পিতা মাতা বংশকুলহীন-সে নিজেও জানতো না সে কি মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু না বৌদ্ধ। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর একটাই-‘আমি মানবপ্রেমী, মানবতাই আমার ধর্ম, সত্য আর শান্তিই আমার পথ।’ মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতো- আচ্ছা ইসলাম কি মুসলমানের ধর্ম? নিজেই আবার উত্তর দিতো-সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়-তিনি যা সৃজিয়াছেন-তা সকলের, তাই ইসলামও সকলের। এইরূপ নানা প্রশ্ন নানা উত্তর। আবার বলতো-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নিউটন, আইনস্টাইন এত কিছু পেলো কি করে? নিজেই উত্তর দিতো-পৃথিবীকে চালাতে সবই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তাই রবীন্দ্র আর নজরুল সৃষ্টিকর্তার রূপ ব্যতীত অন্য কিছু নন- গীতাঞ্জলি, গীতবিতান, সঞ্চয়িতা, ক্যালকুলাসসহ সকল কিছুই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।

কুদরত এর কথা হলো আমি আমার সৃষ্টিকর্তাকে এক ও অদ্বিতীয় মানি এবং সর্বক্ষণই তাঁকে স্মরণ করি। এর জন্য আমার মসজিদ, মন্দির, গীর্জা কিছুই প্রয়োজন হয় না, যেমন- করোনা পরিস্থিতিতে মক্কা –মদিনাসহ সকল মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয়ের ইবাদত বন্ধ। তাই বলে কি সৃষ্টিকর্তার ইবাদত বন্ধ রয়েছে। বন্ধ নেই বরং- বাড়িতে বাড়িতে, পথে ঘাটে ইবাদত বেড়েছে। কেননা মানুষ আজ এক হয়েছে। সৃষ্টিকর্তাই এসকল কিছু করছেন। তিনি চান সকল মানবকুল ও সৃষ্ট জীবসমূহ যে কোনভাবেই উনার ইবাদত করুক। আর ইবাদত ব্যতীত মুক্তি নেই।

কুদরত ও ফকির তারা একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে এক নির্জন স্থানে কর্মরত। আর ফকির তারা আমাকে এসকল তথ্য জানাচ্ছেন। গেল রাতের কথা- জোছনায় আলোকিত চারিদিক। বিশাল এক বিলের এক প্রান্তে ফকির তারা আর অন্য প্রান্তে কুদরত। সারারাত জোছনার আলো দ্বারা তাঁরা করোনা ভাইরাসকে আবদ্ধ করেছে। এ তো এক অদ্ভুত কথা। ফকির তারা জানালেন কেন এবং কিভাবে তা জিজ্ঞেস করে সময় ক্ষেপন করা যাবে না। যেরুপে যা জানাচ্ছি তা লিপিবদ্ধ করে রাখুন।

হঠাৎ কুদরত জানালো, এক অদৃশ্য অবয়ব তাকে জানালো-তুমি মুসলমান নাকি হিন্দু তা বিবেচ্য নয়-তোমাদেরকে করোনা মুক্ত করতেই সৃষ্টিকর্তা আমাদের পাঠিয়েছেন। প্রশ্ন করে কুদরত-কেন? সৃষ্টিকর্তা নাকি শুধু মুসলমানদেরকেই রক্ষা করবেন-আর বাকি সবাই নাকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে!

অদৃশ্য অবয়ব সমস্বরে চিৎকার করলো, যা আমিও শ্রবণ করলাম- ‘বেওয়াকুফ, অজ্ঞতার কারনে মহানবী হযরতকে পেয়েও তোরা অসহায়! শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব অন্যান্য নবী-রাসুল, অসংখ্য অলি-আউলিয়া, সূফী সাধক পেয়েও তোরা নির্জীব অসহায়। মহান সৃষ্টিকর্তা তোদের এহেন আচরণে অত্যন্ত বেজার ও অসন্তুষ্ট। সৃষ্টির পর হতে যে সকল কারণে তিনি অসন্তুষ্ট-

· সকল আসমানী রহমত অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের কিতাবসমূহ তোরা বিশ্বাস করিস না।
· কিতাবসমূহে যা বলা হয়েছে তার ভুল ব্যাখ্যা করিস।
· বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত জ্ঞান ও নিদর্শন বিপথে প্রয়োগ করিস।
· তোদের মধ্যে অযোগ্য মানুষজন অর্থের জোরে নেতা, ঈমাম ও দলপতি।
· তোরা কতিপয় মূর্খ ও স্বল্প বিদ্যার কাণ্ডারীদের ওয়াজ এবং জালসা দ্বারা বিভ্রান্ত।
· পরমাণু বোমা, যুদ্ধ বিমান ও অস্ত্র খেলায় তোরা মত্ত।
· অর্থ বিত্ত বৈভবে তোরা মশগুল।
· আসমানী ও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জ্ঞানের অপচর্চা করে তোদের মধ্যে তোরা সৃষ্টি করেছিস শ্রেণী বিভাজন।

· তোরা আইনের ফাঁকে পুরুষেরা নারীদের ঠকাস, ধনীরা গরীবদের ঠকায়- আর সম্পদ কুক্ষিগত করতে কোন কোন ক্ষেত্রে কতিপয় নারী ও পুরুষ একগোত্রে শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাস। মানবমুক্তি ও সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত ইবাদত রেখে তোরা লোক দেখানো আধিপত্যের ইবাদত করিস এবং এ কারনে রাহমানুর রহিমের ভীতি ছড়িয়ে নিজেদের সম্পদ কুক্ষিগত করিস।

· সৃষ্টিকর্তার ভীতি প্রদর্শন করে তোরা মসজিদ, মন্দির, গীর্জা বানিয়েছিস-যেখানে তোদের মাঝেই রয়েছে বিভক্তি-অর্থাৎ, সেখানে তোদের আধিপত্য বিস্তার ব্যতীত সৃষ্টিকর্তার ইবাদত হয় না।

· মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে বৈষম্য ও শোষণ করিস-এমনকি পবিত্র হজ্জ্ব যাদের জন্য নয়, তাদেরকে প্রচার করিস পাপ মুক্তির স্থান হলো মক্কা ও মদিনা। আরে অজ্ঞ ও মূর্খের দল-কুদরতের ধন হরণ করে ফকির তারা হজ্জ্বে গেলো- সৃষ্টিকর্তা ফকির তারাকে পাপ মুক্তি দিবে?

· শোন অজ্ঞ সমাজ- তপ্তময় বালুতে খালিপায়ে সৎ ধনী সমাজ (যাদের আয় সৎ) সাফা-মারওয়া করলে তারা গরীব শ্রেণীকে উপলব্ধি করতে পারে, আর খোলা ময়দানে তাঁবুতে থাকলে বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা সৎ ধনী সমাজ উপলব্ধি করতে পারে- এ কারণে মহান সৃষ্টিকর্তা কেবল ঋণবিহীন সৎ ধনী সমাজের জন্য হজ্জ্ব ফরয করেছেন, কিন্তু অসৎ ধনীদের জন্য নয়-আর পাপমুক্তির জন্য তো নয়ই। যদি তাই হতো, তাহলে কোটি কোটি গরিবের পাপমুক্তি কি করে হয়? তাছাড়া, সৃষ্টিকর্তা তো কেবল ধনী শ্রেণীর জন্য নয়।

· অথচ আজ সোনা গয়নার ব্যবসা, সাফা-মারওয়া করা হয় এসি ঘরে, জমজম টাওয়ার, রেডিসন, হিলটন-এসব কোন্ সৎ ধনী শ্রেনীর জন্য? হজ্জ্বের ময়দানে তো সৎ ধনীদের কোন ভেদাভেদই থাকার কথা নয়-আর গরীবদের জন্য হজ্জ্ব কি? গরীব তো দিন আনে দিন খায়-তাহলে অসুস্থ মাকে বিমার রেখে গ্রামাঞ্চলের যে দরিদ্র মানুষেরা কোন রকমে জমি বেচে হজ্জ্বে যাচ্ছে-তাতে সৃষ্টিকর্তা কি খুশি হচ্ছেন? না না- তিনি অত্যন্ত বেজার হয়েছেন।

· তোদের মধ্যে রয়েছে শোষণের অর্থে সজ্জিত ধনী দেশ-যারা নাকি বিশ্ব চালায়। আর গরীব দেশগুলো অবাক দৃষ্টিতে তা অবলোকন করে। এতেও সৃষ্টিকর্তা বেজার হয়েছেন।

· কুদরত আর ফকির তারা- মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তোরা জোছনার আলোতে হাজির হয়েছিস-মহান সৃষ্টিকর্তা জানালেন, তোদের ঐ সকল শ্রেণীর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে তিনি অবশ্যই অবগত। আর নিশ্চয়ই তিনি তাদের দ্বারাই তৈরি করেছেন পরমাণু বোমা-এ জন্যই যে জ্ঞান অর্জন করা ভালো, বৈজ্ঞানিক হয়ে আবিষ্কার করা ভালো, আলেম হয়ে ঈমামতি করা ভালো, কোরআন হাফেজ হয়ে ওয়াজ করা ভালো, শিক্ষক, সাংবাদিক, অফিসার, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, নেতা হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেয়া ভালো- কিন্তু শুকরিয়া আদায় না করে যার যার পেশায় সে সে যে পরিমানে ডুবে ডুবে জল খেয়েছে তারই পরিনতি আজকের করোনা ভাইরাস। বলে দিস- এই করোনা ভাইরাসের পর দেওয়া হবে অপর এক ভাইরাস-যে ভাইরাস পৃথিবীর কোন মাটিতেই শস্য জন্মাতে দিবে না-ফকির তারার কেরামতি আর কুদরতের কুদরতিতে করোনা ভাইরাস হতে মুক্তি দিলাম। তবে স্মরণ করিস সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন, সূফী সাধক আনোয়ারুল হক ও সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফকে। তাঁরা সকলেই আমার প্রিয় বান্দা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর আত্মা আর আমারই রূপ।

‘বাবা, সারারাত ঘুমাই নি। লোকচক্ষুর আড়ালে কতো কিছু হচ্ছে। আচ্ছা বাবা, কুদরত চাচা আর ঐ যে ফকির তারা উনারা উত্তরবঙ্গের কোথায় আছেন?’

‘হুম। কোথায় আছে-তা আমি জানি। তবে তোরাও একদিন জানতে পারবি। আসলে ঐটা ফকির তারার আস্তানা। কুদরত আজকাল ঐখানে খুবই ঘনঘন যাতায়াত করে। শীঘ্রই আমিও যাব।

কুদরতের কুদরতি হল ফকির তারা।’
###
(তারিক মাহমুদ, কবি, প্রবন্ধকার, সংসদ ও রাজনৈতিক গবেষক)

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ৩ মে ২০২০ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "গল্প : কুদরতের কুদরতি"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*