সর্বশেষ

করোনা দূর্যোগ ও সমকালীণ ভাবনা

মোঃ মঞ্জুরুল হোসাইন : “কপালে আগুন জ্বলে না, তবু লোকে বলে কপাল পুড়েছে।”- এখন দেখার বিষয় কতটুকু পুড়েছে, বাকীটুকু বাচবে কিনা!! ৮ দিন পর বাজারে গিয়ে পলে পলে অনূভব করেছি যে আমরা আসলেই বীরের জাতি, জর্দা দিয়া পান খাই, বিড়ি-সিগারেটের দোকানে জম্পেস আড্ডা চলছে, আড্ডার বিষয়ও করোনা ভাইরাসের অসহায়ত্ত্ব, কিছু করতে পারবেনা এই রোদ-বৃষ্টিতে ভেজা এবং সবকিছুতেই ভেজাল খাওয়া মানুষগুলোর। কিছুপর, মসলা ভাংগানোর দোকানের সামনে যেতেই দেখি, সেখানে ২ জনের মারামারি অবস্থা, বিষয় হাচি দেয়া- যা যথারীতি আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করছেন। খুব কাছেই একজন ভলেন্টিয়ার অসহায়ভাবে মাইক দিয়ে সকলকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বলে যাচ্ছেন -এই হল সার্বিক চিত্র।

একটি মংগোলিয়ান প্রবাদ আছে, “There are those who walk in the woods and see no trees”, এই মানুষগুলো দেখেও আমার এমনি মনে হয়। তাই, করোনা বিষয় নিয়ে কিছু লিখার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে হল কিছু বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ সবাইকে শেয়ার করা দরকার।

১. আজকের করোনা আপডেটে ২টি সুচক বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ১টি হল মোট মৃত্যুঃ ১২৭, অন্যটি মোট সুস্থঃ ১০৮, যা আমার কাছে অত্যন্ত ভয়ানক ও হতাশাব্যাঞ্জক বলে অনুভূত হয়েছে। অর্থাৎ, এখানে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের চিকিতসার কোন ত্রুটি বিচ্যুতি বা কমতি আছে বলে প্রতিয়মান হয়। কারণ, অন্যান্য দেশ, এমনকি আমাদের চেয়ে অনুন্নত ও জনবহুল দেশের ক্ষেত্রেও গ্রাফটি এমন নয়। আজকের ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে একটি দেশও পাওয়া যায়নি, যেখানে মৃত্যু সংখ্যা বেশি, সুস্থ হওয়া সংখ্যা কম। আবার, টেলিভিশন খুলে দেখি হসপিটালগুলোতে সাস্থ্যকর্মিরা রোগীদের কাছে না গিয়ে চিকিতসা দিচ্ছে বলে অনেক রোগীর অভিযোগ, অন্যদিকে প্রচুর সাস্থকর্মী করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি মারাও গেছেন (আমি সকলের রুহের মাগফিরাত কামনা করি)। যেখানে অন্যান্য দেশের ডাক্তার বা সাস্থ্যকর্মীদের দেখলে মানুষ দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয়, এপার্টমেন্টের বাসিন্দারা গিফট পাঠায়, যে যার মত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেখানে আমাদের দেশের ডাক্তারদের যদি আক্রান্ত হওয়ার ভয় নিয়ে সেবা প্রদান করতে হয়, তাহলে রোগী সুস্থ হওয়ার এই সংখ্যাটা বাড়ানো খুব চ্যালেঞ্জিং হবে বৈকি।

২. বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক), ১৮(১) ও ৩২ অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্য সেবা ও জীবন ধারনের অধিকারের বিষয়ে বলা হয়েছে। সেলক্ষ্যে, সরকারের পদক্ষেপের কিছু কমতি হয়ত এখনো আছে, তবে নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে এতে সন্দেহ নেই। তদুপরি, আমার মনে হয় এই ভাইরাস মোকাবেলায় জনগণের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী। জনগণকে বুঝতে হবে যে, করোনা দূর্যোগের কোন প্রশ্নের উত্তর ঘরের বাইরে নেই; কোন সরকার কিংবা হাসপাতালেও নেই, উত্তর আছে শুধুমাত্র আমার আর নিজের দায়িত্ববোধের কাছে। এই বোধটুকু জাগ্রত করতে না পারলে এই সাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মীবাহিনী তথা দেশের আপামর সচেতন জনতা, যারা প্রযোজ্য সকল নিয়মগুলো দায়িত্ব হিসেবে মেনে চলছেন একটি সুদিনের আশায়- তাদের সকলের প্রতি পবিত্র সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলো প্রহসন হিসেবেই থাকবে। কিন্তু উপায় কি?

৩. ফিলোস্ফির ছাত্র হিসেবে আমি জানি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ৫-১৫% sadism রয়েছে, যার কারনণ আমরা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করতে চাইনা, স্ত্রী স্বামিকে আর স্বামী স্ত্রীকে সন্দেহ করে, অধীনস্তকে খুব সামান্য স্বার্থের কারণেও তার বসে্র প্রতিহিংসার স্বীকার হতে হয় অথবা গরীব বড়লোকদের দেখতে পারে না, আর বড়লোক গরীবদের; মানুষের চাইতে এখন ল্যাপ্টপ আর মোবাইলের স্ক্রিনি আমাদের কাছে বেশি প্রিয়। আবার, সুনামী, আইলা বা সিডরের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেখা যায়, সেই মানুষগুলোই পাশের মানুষের জন্য সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজ জীবন বিপন্ন করেও কাজ করে বা করতে চায়। এটি সম্ভব হয় তার ভিতরকার সাহস আর ভালবাসার শক্তি দিয়ে-এটাই মানবতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের এই শক্তিটাকেই কাজে লাগাতে হবে। অপরের অবদানকে বড় করে দেখতে হবে। সকলকে বুঝাতে হবে, আপনি শুধু আপনার পার্টটা ঠিকভাবে করুন। আপনার কারনণ যেন অন্য কারো কোন ক্ষতি না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখুন। বাসার মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবুন যে সাত দিন পর হয়তো আপনি নাও থাকতে পারেন। ওদের দেখার জন্য অথবা ওদের কেউ নাও থাকতে পারে আপনার সামনে। আপনার হাতে হয়তো তখন করার কিছুই থাকবে না। তাই এখন যে সময়টা হাতে আছে সেই সময়টা অন্য কিছু না ভেবে সঠিক ভাবে কাজে লাগান।
সাংবাদিকদের বিনীতভাবে বলব, চ্যানেলগুলোতে এত বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন না দিয়ে কয়দিন বেশি বেশি প্রেরনা বা প্রনোদনামূলক বিজ্ঞাপন দিন। যারা সম্মুখে থেকে নিজ জীবন বিপন্ন করে এই যুদ্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, নিজের পরিবার-পরিজনের কথাও ভাবছে না- এটা তাদের প্রাপ্য।

“চল একসাথে দূরে থাকি, বিশ্বাসে কাছাকাছি,
দূরে দূরে কাছে থেকে দেশটাকে ভাল রাখি।”

(মোঃ মঞ্জুরুল হোসাইন, সভাপতির একান্ত সচিব, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি)

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ২৪ এপ্রিল ২০২০ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "করোনা দূর্যোগ ও সমকালীণ ভাবনা"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*