ঢাকা : স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, বাজেটে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের প্রতিফলন ঘটেছে। ২০৩০ সালে এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহ অর্জনের সময়সীমা, ‘রূপকল্প-২০২১’ এর মত ‘রূপকল্প-২০৪১’কে সামনে রেখে এবারের বাজেট প্রণীত হয়েছে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। যেখানে অর্থনীতির চালিকা শক্তি হবে উন্নত প্রযুক্তি ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি।
গত ৩ জুলাই একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ (বাজেট) অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণার আগে সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলেন তিনি। অধিবেশন পরিচালনায় সংসদ সদস্যদের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, সংসদের সকল কর্মকা- পরিচালিত হয় সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি ও সংসদীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে। সংসদ পরিচালনায় সংসদ-সদস্যদের সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য। এ অধিবেশনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এ সময় স্পিকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল সামরিক স্বৈরশাসনের পালাবদলে একের পর এক সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সেদিন আইনের শাসনের পরিবর্তে কালচার অব ইনফিনিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আইনের শাসন পর্যুদস্ত হয়েছে, গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। কাজেই অনুধাবন করতে হবে এরকম বৈরী আবহাওয়া থেকে লুপ্তপ্রায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আজকের এই অবস্থানে আনতে কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। গণতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রয়োজন হয় একটি স্থায়ী নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মৌলিক কাঠামো।
স্পিকার বলেন, আমি বলছি না গণতন্ত্রের আবহে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে না। অবশ্যই আলোচনা-সমালোচনা থাকবে, ভিন্নমত পোষণ, দ্বিমত পোষণ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রকে সুসংহত করে। কিন্তু সেই সমালোচনা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করে হলে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে অধিকতর পরিশীলিত করতে অবশ্যই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর ভীত রচিত হয়েছে। এই কাঠামোকে অধিকতর শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অব্যাহত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সকল অর্জনকে ধরে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আজ স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে মনীষী ও গবেষকদের সকল ভবিষ্যৎ বাণী প্রফেসি ও ফোকাসকে ভুল প্রমাণিত করে, সকল নেতিবাচকতাকে নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এ যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপ্রত্যয়ের অমর বাণী মনে করিয়ে দেয় দাবায়ে রাখতে পারবা না।
স্পিকার বলেন, ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত পাকিস্তানকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আরও দেখতে পাই বাংলাদেশের জিডিপি’র পার ক্যাপিটা বিগত এক বছরে শতকরা ৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ২২২৭ ইউএস ডলার উন্নীত হয়েছে। যেখানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৫৪৩ মার্কিন ডলার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭০ ভাগ ধনী ছিল, আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে শতকরা ৪৫ ভাগ ধনী। অথচ একজন পাকিস্তানি অর্থনীতিবীদ হতাশার সুরে বলেছেন, এখন এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে যে ২০৩০ সালে আমরা বাংলাদেশের এইড বা সাহায্য চাইছি।
শিরীন শারমিন বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ রেখে চলছে। সম্প্রতি শ্রীলংকার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। একটি তৎকালীন দরিদ্র সাহায্য প্রাপ্তির দেশ থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। এটা বাংলাদেশের ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যতম খেলোয়াড় হয়ে ওঠার কারণেই সম্ভব হয়েছে। সুদান আর সোমালিয়ার ঋণ মওকুফ একই প্রমাণ দেয়। আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হতদরিদ্র গৃহহীন মানুষের মাঝে ৯ লাখ ঘর। মানুষের মাথা গোঁজার ঠাই তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
স্পিকার বলেন, তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান করে নেওয়া বাংলাদেশ একটি অনন্য পরিবর্তন। কীভাবে ঘটল এই ব্যাপক পরিবর্তন। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি তার অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে হলে ইতিহাসের লেন্স দিয়ে দেখতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মেধা জ্ঞান ভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভিশন ২০২১ রূপকল্প ঘোষণা করেন তারই পথ ধরে আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশ।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ১৩টি বাজেট বিল্ডিং ব্লক এর মত রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের উন্নয়ন কাঠামো স্থাপন ও ভিত রচনা করেছে। বিশ্বের অনেক গবেষণা থেকে দেখা যায় গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝে এক নিগূঢ় যোগসূত্র রয়েছে। বলা যেতেই পারে গত ১৩ বছরের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব, কার্যকর অগ্রযাত্রা সংবিধানসম্মত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন, সঠিক নেতৃত্ব আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত রচনা করেছে। সেই সাথে রয়েছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের নিরন্তর প্রচেষ্টা, নিরলস শ্রম, গভীর দেশপ্রেম আত্মপ্রত্যয় ও শত প্রতিকূলতার মাঝে রুখে দাঁড়ানো ও ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য সাহস ও সক্ষমতা।
স্পিকার বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যাপক সমালোচনা শুনে থাকি। জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্ট এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও না না কটাক্ষ শোনা যায়। আমাদের গণতন্ত্রকে অন্য অনেক দেশের গণতন্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তাহলে কোন গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে? তাহলে কি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে? আসুন তাহলে একটু দেখি। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কখন ঘটে? সেটা তখনই ঘটে যখন তার জন্য একটি মৌলিক কাঠামো তৈরি করা হয়। কোন গণতন্ত্র কতখানি কনস্যুলেট করবে তা নির্ভর করে কিছু উপাদান বা নিয়ামকের উপস্থিতির উপর। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সুশাসন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, ক্রিয়াশীল থাকা অত্যন্ত অপরিহার্য।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রয়োজন হয় একটি স্থায়ী নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মৌলিক কাঠামো। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিবর্তনের ইতিহাসে একটু বিশ্লেষণ করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে আমাদের দিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও সমাজতন্ত্র চারটি মূলনীতি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সামরিক ফরমান জারি মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সংবিধান। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল সামরিক স্বৈরশাসনের পালাবদলে একের পর এক সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আইনের শাসনের পরিবর্তে সেদিন কালচার অব ইনফিনিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আইনের শাসন পর্যদুস্ত হয়েছে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। কাজেই অনুধাবন করতে হবে এরকম বৈরী আবহাওয়া থেকে লুপ্তপ্রায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আজকের এই অবস্থানে আনতে কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তাই ১৭ মে ১৯৮১ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট। দীর্ঘদিন নির্বাসিত থাকার পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
সমাপনী বক্তৃতায় স্পিকার বলেন, মৃতপ্রায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য মৌলিক কাঠামো নির্মাণে ছিল অপরিহার্য ও পূর্বশর্ত। যা জননেত্রী শেখ হাসিনা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সংবিধানের ভেতর থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে ট্রাকে তুলতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে আইনের শাসন, বিচার পাওয়ার অধিকার, ভোটের অধিকার, মৌলিক কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। শুরু হয় আন্দোলন-সংগ্রাম স্বৈরশাসনের অবসানের সংগ্রাম, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জনগণের ভোট পাওয়া নিশ্চিত করার সংগ্রাম। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার আন্দোলন। সংগ্রাম আন্দোলন অনেক রক্ত ঝরা পথ এসেছে আজকের গণতন্ত্র।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ৩ জুলাই ২০২১ ইং
Be the first to comment on "বাজেটে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের প্রতিফলন ঘটেছে ॥ স্পিকার"