জেসমিন প্রেমা #
করোনা মহামারিতে মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোভিড-১৯ বিশ্বের কাছে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ। এতো বড় যুদ্ধ, এতো কঠিন যুদ্ধ মানবজাতিকে নিকট অতীতে লড়তে হয়নি। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ চোখের আড়ালে থেকে আক্রমণ করছে।’ এই কঠিন লড়াই মোকাবেলা করতে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হচ্ছে সারা বিশ^বাসী। করোনা সংক্রমণের ফলে শারিরীর দুর্বলতার পাশাপাশি দুঃশ্চিন্তা, অবসাদসহ নানান সমস্যা যেমন তৈরি হচ্ছে। একইভাবে কর্মহীনতা, ব্যবসায়িক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে। গত প্রায় দুই বছরে চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন। এসব কারণেই মানসিক চাপ বা অস্থিরতা বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। বাংলাদেশও এই চিত্রের বাইরে নয়। তবে ইতিবাচক হচ্ছে- মানসিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের মানুষের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার হারও বেড়েছে।
সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)’র মানসিক স্বাস্থ্য টিমের তথ্যমতে, করোনাকালে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। মানসিক চাপে আছেন বয়স্ক ব্যক্তিরাও। বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। করোনাকালে মানসিক যে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা, হতাশা, সারাদিন মন খরাপ, খাবারে অরুচি বা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাবার গ্রহণ, ঘুমের সমস্যা, নেতিবাচক চিন্তা, আত্মহত্যার চেষ্টা বা মৃত্যু চিন্তা, শরীরে নানা রকম ব্যাথা বা অস্বস্তি অনুভব, অমনোযোগী হওয়া ও নিজেকে ছোট মনে করা ইত্যাদি।
স্কাসের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অবসাদ ও উদ্বেগ বেড়েছে এবং এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। করোনার কারণে মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তায়, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে একটা বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ মানুষের কথায় ও কাজে একটা নেতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। যেটা মানুষের জীবনকে আরো কঠিন করে তুলছে। যার প্রতিফল হিসেবে নানাধরণের সহিংসতা বেড়েছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের কোভিড-১৯ ফোকাল ডা. ইয়াসির আরাফাত জানান, করোনা পরবর্তীতে বিশেষ করে আক্রান্ত হওয়ার দুই মাস পর থেকে মানসিক বিষন্নতা ও দুঃশ্চিন্তায় প্রায় ৪০ শতাংশ এবং স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকেন প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী। এছাড়াও ঘুমের সমস্যায় ভোগেন প্রায় ৫০ ভাগ। তিনি আরও বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে একটা মানসিক দুঃশ্চিন্তা কাজ করে। শরীর ভালো লাগে না। ভয় পায়। এমন পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা প্রথম থেকেই জরুরী। সুস্থ হওয়ার পরও একজন চিকিৎসকের ফলোআপে থাকা দরকার। চিকিৎসক কথা বলে বুঝতে পারবেন, রোগীর মানসিক অবস্থানটা কি। সে অনুযায়ী তাকে পরবর্তীতে ব্যবস্থাপত্র দিতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, আমরা এমনও দেখেছি, তিন মাস বা তার বেশি সময় পরও অনেকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। করোনা হয়েছিলো, সেটা ভুলতে পারে না। তখন তার চিকিৎসা ও সাইকোথেরাপী দুটোই প্রয়োজন। তাদের স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে দেরি হয়। নিয়মিত এ ধরনের রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন বলে জানান ওই চিকিৎসক।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তারেকুল ইসলাম বলেন, করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় নাকাল কক্সবাজার জেলা। একদিকে মায়ানমার এবং অন্যদিকে বান্দরবন ও চট্টগ্রাম জেলা বেষ্টিত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার চরম ঝুকিঁতে রয়েছে। এছাড়া প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার দীর্ঘদিন এই এলাকায় অবস্থান এই আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। করোনার প্রভাবে মৃত্যু, বেকারত্ব, কর্মহীনতা, শিক্ষা ও ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত কক্সবাজার জেলার মানুষ ভুগছে নানান মানসিক সমস্যায়। এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘দেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি উপেক্ষিত। দেশের মোট বাজেটের দশমিক ০৫শতাংশ বরাদ্দ থাকে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে, যেটা একেবারেই অপ্রতুল। এরপর করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তারেকুল ইসলাম আরো বলেন, দীর্ঘ লকডাউন, করোনার ভয়, চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া, পরিবারের সদস্য বা পাড়াপড়শির আক্রান্ত হওয়া, সামাজিক দূরত্ব, চার দেওয়ালের মধ্যে মূলতঃ নিজেকে বন্দি রাখার প্রভাব এখন ভালোভাবেই পড়ছে সাধারণ মানুষের মনের ওপর। এরফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন মানুষ। দুঃশ্চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগসহ নানাধরনের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর অজ্ঞানতা কিংবা অস্বস্তি বোধ যে কোন কারণেই হোক, মানুষ এই মানসিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে চায় না। সমস্যাগুলো নিজের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেন। ফলে সমস্যা আরো বাড়ে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা করোনা মহামারীর কবলে পড়ে মানসিকভাবে আরো ভেঙ্গে পড়েছে। মহামারীর কারণে বিভিন্ন নির্যাতনের হারও বেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য সেবা (মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট) জোরদার করা দরকার। যাতে করোনাকালীন অবস্থায় সকলেই সামান্য হলেও স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা করতে পারে।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শরণার্থী শিবিরে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের মানসিক চিকিৎসা সেবা শুরু করেছে। ‘এই মহামারিকালে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি খুবই জরুরী বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইয়াসির আরাফাত। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে ক্যাম্পে ফেরার পর সেখানকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান। খুব বেশি সমস্যাা না হলে, আর পাসপাতালে আসেন না। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অধীনে ক্যাম্পগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছে। তারা নিয়মিত সেবা দিয়ে থাকেন। এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত করা কোন অবস্থাতেই উচিত হবে না। বরং এই মুহুর্তে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের মতো, সকল শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরাও মনে করে করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নিজ দেশ ছেড়ে যারা বিদেশের মাটিতে উদ্বাস্তÍু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই উদ্বাস্তু বা শরণার্থী মানুষদের বিষয়ে আরো সতর্ক থাকা দরকার। অবশ্য মনোবিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন। নিশ্চয়ই আঁধার কেটে যাবে। নতুন সূর্য উঠবে। জয় হোক জীবনের।
###
(লেখক : মানবাধিকার কর্মী ও চেয়ারপার্সন, স্কাস)
Be the first to comment on "করোনায় সর্বত্র বাড়ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা"