সাকিলা পারভীন # গণপরিবহনে যাতায়াতকালে নারী যাত্রীদের ৯৪ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ ওই সকল যৌন হয়রানির শিকার নারীদের ৮১ শতাংশই প্রতিবাদ করেন না। আরো বেশী হয়রানির আশংকায় তারা চুপ থাকেন, এড়িয়ে যান। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক গবেষণার ফলফল থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ ৪ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যৌন হয়রানি এবং শরীরের অবাঞ্ছিত স্থানে অনধিকার চর্চা, সেইসঙ্গে অননুমোদিত যৌন কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন। সহজ কথায় কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন জিঘাংসা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়কেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন। নারী বা পুরুষ যেকেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী, কন্যাশিশু এবং ছেলে শিশুরাই অধিকমাত্রায় আক্রান্ত হয়। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া মানুষটিই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ বিষয়ে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। এটি নির্মূল করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও জরুরি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে যৌন হয়রানির ঘটনায় নারীদের প্রতিবাদ করার হার খুবই কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের ৪১৫ জন নারীর সাক্ষাৎকারের ভিক্তিতে তৈরি করা ওই গবেষণা প্রতিবদেন থেকে জানা গেছে, গণপরিবহনে ১৯-২৫ বছর বয়সে পুরুষের দ্বারা নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। আর ৫৯ শতাংশ নারী জানিয়েছেন তারা ২৬-৪০ বছর বয়সে উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন। এসব ৮১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন তারা চুপ ছিলেন প্রতিবাদ করেননি।
গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ সাদ আন্দালিব বলেন, যৌন হয়রানি সামাজিক ব্যাধি। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এ ব্যাধি থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। গণপরিবহনে এই মাত্রা সব থেকে বেশী। প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যের থেকে বাস্তবে ঘটনা আরো বেশী। কারণ নতুন কওে হয়রানির আশঙ্কায় যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। তাই বিশ^ যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবসটিকে ধরে প্রচার-প্রচারণা ও বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার। এ হার ৫৩ শতাংশেরও বেশি। এই শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি বন্ধে উচ্চ আদালতের সুনির্দ্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি
প্রসঙ্গত, এ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নিদের্শনা দেয়। তাতে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য থাকতে হবে। একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে যদি কোন অভিযোগ পান তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। তদন্তর নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। কেউ চাইলে সারাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু হাইকোর্টের নিদের্শনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের কমিটি থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই। ফলে বাড়ছে যৌন হয়রানি।
উন্নয়ন সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)’ শিশুবিষয়ক সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনার কারণে বিগত বছরের বেশির ভাগ সময় জনসমাগম স্থলে শিশুদের তেমন উপস্থিতিও না থাকলেও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৮১৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের এ সংখ্যা ছিল ৬২৬। এছাড়া একই সময়ে আরও ৯৪ জন শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪ মেয়ে শিশু। এই সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০টি শিশু।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর জরিপের তথ্যে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালে ৬৯২ জন নারী ও ৯৪৫ জন শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে ৩৯৬টি, গণর্ধষণের ঘটনার শিকার হয়েছেন ১০৭ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ১১ জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৮২ জন ও যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছেন আরো ৮২ জন নারী। অবশ্য বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে সাতজন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বলে তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
যৌন নিপীড়নসহ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করছে বেসরকারী সংস্থা ‘টিম এসোসিয়েট’। সংস্থাটির টিম লিডার পুলক রাহা বলেন, যৌন হয়রানি থেকে শিক্ষার্থীদের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এ ঘটনার শিকার শিক্ষার্থী পরিবারের সদ্যসের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। অনেক নিরুপায় অভিভাবক ভয়ে সন্তানের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে গৃহবন্ধী করে রাখে। কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। বিচারহীনতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা ও সচেতনতার অভাবকে যৌন নিপীড়ন বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ বলেন, যৌন নিপীড়নসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগের ফলে জনগণের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হেল্পলাইন চালুর পর দেড় কোটি মানুষ সরকারি সেবার আওতায় এসেছে। তবে এ বিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ০৪ মার্চ ২০২২ ইং
Be the first to comment on "আজ যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস ॥ গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হয়েও চুপ ৮১ শতাংশ নারী"