সর্বশেষ

তলনীতে পাকিস্তানের রিজার্ভ, শ্রীলংকা হওয়ার আশঙ্খা

স্কোয়াড্রন লিডার (অবঃ)সাদরুল আহমেদ খান # ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, উচ্চ বাহ্যিক ঋণ পরিশোধ এবং নগদ ডলারের প্রবাহ স্বল্পতার কারণে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে তাদের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। যা দিয়ে মাত্র দেড় মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধ করা যাবে। দেশটি অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে শ্রীলংকার মত অবস্থা হতে পারে। অথচ বাংলাদেশ অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অনেক মজবুত অবস্থায় আছে।

এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছেন বাংলাদেশ। এই পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক টালমাতাল পাকিস্তানও ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশে। অথচ স্বাধীনতার পরপর এসব খাতে ওই দুটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে ছিল। বিশেষ করে আয় ও আয়ুতে দুই প্রতিবেশীর চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণও তুলনামূলক বেশি, যা নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।

স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান (এসবিপি) দ্বারা প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ৬ মে শেষ হওয়া সপ্তাহে প্রবাহ ১৬.৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগে ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার ছিল৷

দেশের রিজার্ভ সপ্তাহে ১৭৮ মিলিয়ন ডলার বা ১.১% কমে ১৬.৩৭৬ বিলিয়নে ডলারে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য দেখায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও ২৩ মাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীনের সময় রিজার্ভ এক ডলারও ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ পাঁচ দশকেই উন্নীত হতে চলেছে উন্নয়নশীল দেশে। বাংলাদেশের যাত্রার শুরুতে এটিকে বলা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। এখন এ দেশ পরিচিতি পাচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ১৯০ মিলিয়ন ডলার কমে ১০.৩০৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যা বহিরাগত ঋণ পরিশোধের সাথে সম্পর্কিত বহিঃপ্রবাহের জন্য রিজার্ভ হ্রাসকে দায়ী করেছে।

বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন যে এই রিজার্ভ ১.৫৪ মাসের জন্য আমদানি মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে পারবে। অর্থনীতির পরিভাষায় অন্তত তিন মাসের আমদানি মূল্য রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করার সক্ষমতাকে মজবুত অর্থনীতি বলে, সে অর্থে পাকিস্তান ঝুঁকিতে আছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ছয় মাসের আমদানি মূল্য রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করার সক্ষমতা বজায় রেখে চলছে।

তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভ ৬.০৫৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬.০৬৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান দ্বিগুণ ঘাটতি (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং বাণিজ্য), বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহের অভাব এবং বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার বাধ্যবাধকতা বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।

পতনশীল রিজার্ভ মুদ্রার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে কারণ এটি আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার প্রতি ১৯১.৭৭ রুপি এটা সর্বকালের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বেলআউটের পুনরুজ্জীবনে বিলম্ব এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলি থেকে তহবিলের প্রতিশ্রুতির অভাব বৈদেশিক রিজার্ভ এবং স্থানীয় ইউনিটের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গত মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, আইএমএফ বেলআউটের পুনরুজ্জীবনের জন্য মোটামুটি একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছেন কারণ এটি অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে আরও আর্থিক সহায়তার পূর্বশর্ত।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের মধ্যে আমদানি ও ঋণ পরিশোধ মেটাতে দেশের দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ প্রয়োজন। তবে, বর্তমান সরকারকে ব্যয়বহুল জ্বালানি ভর্তুকি কমাতে হবে, যা তৎকালীন ইমরান খানের সরকার চালু করেছিল।

পরবর্তী ঋণের কিস্তি মুক্তির জন্য আইএমেফ থেকে অনুমোদন পেতে পেট্রোলিয়াম এবং বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে।

সব মিলিয়ে পাকিস্তান এক জটিল অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে নতুন সরকারের জন্য এ থেকে মুক্তি পাওয়া ‘ডু ওর ডাই’ পরিস্থিতি। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধারী এই দেশ সংকট নিরসনে কোন বন্ধু প্রতিষ্ঠান ও রাস্ট্রকে কাছে পায় সেটাই দেখবার বিষয়।

দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। করোনার মধ্যে বিশ্বের মাত্র ২০টি দেশের জিডিপির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশ। আমাদের মাথাপিছু আয় অনেক আগেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছিল। এখন ভারতকেও ছাড়িয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়েছে।

স্বাধীনতার পর পর দেশের মাথাপিছু আয় ৯০ ডলার ছিল। তা বেড়ে এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলারে দাড়িয়েছে। গত বছর যা ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। আগে মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬১ শতাংশ পিছিয়ে ছিল।

দেশে নির্মাণ শিল্পের বৃদ্ধি সিমেন্ট উৎপাদনকে উৎসাহিত করেছে। বেড়েছে চিনি শিল্পের চাহিদা। এমনকি রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্পও ডালপালা বিস্তার করেছে। ফলস্বরূপ জিডিপি প্রোফাইল উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, কৃষি ক্ষেত্র দেশের জিডিপি-তে পুরো এক-তৃতীয়াংশ অবদান রাখে।

সর্বশেষ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে বড় কোনো মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছিল মস্কো। এরপর দীর্ঘদিন দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে এক ধরনের অচলাবস্থা বজায় থাকে। এখন যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার- ইউক্রেন যুদ্ধ। পাকিস্তান রাশিয়াল পক্ষ নেওয়ায় বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা দেশটির উপর নাখোশ। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষ নেত্রীতে ও কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে এসবের কিছু ঘটেনি। বরং সবার সঙ্গে সম্পর্ক আরো মজবুদ হচ্ছে।

(লেখকঃ সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)

পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম, ১৭ মে ২০২২ ইং

Print Friendly, PDF & Email
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Be the first to comment on "তলনীতে পাকিস্তানের রিজার্ভ, শ্রীলংকা হওয়ার আশঙ্খা"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*