সাকিলা পারভীন# কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের ওয়াশরুমের কমোড থেকে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে কমোডে সন্তান প্রসব এবং টয়লেটের পাইট কেটে সেই নবজাতককে উদ্ধারের ঘটনা প্রকাশ গত ৮ মে। একই দিনের অপর একটি খবরে দেখা যায় নড়াইলের কালিয়ায় একটি বেরসকারি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর পর পিছনের দরজা দিয়ে চিকিৎসক পালিয়ে গেছে। গত ৪ মে নেত্রকোণার বারহাট্টায় এক পশু চিকিৎসকের অপচিকিৎসায় মৃত্যু হয় প্রসূতি ও নবজাতকের। গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত এধরণের অসংখ্য মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়েই আজ ২৮ মে পালতি হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। সরকার এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার কমিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বেও পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মা ও শিশু মৃত্যু হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফলতা বেশি। একাধিক গবেষণা তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর চার হাজার ৭২০ জন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়। তাহলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়, আর প্রতি দুই ঘণ্টায় মৃত্যু হয় একজন গর্ভবতী মায়ের। আর এইসব অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর পিছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা হাসাপাতালে না গিয়ে বাড়িতে প্রসব করানো, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অবহেলা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২৮ মে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণই হল নিরাপদ মাতৃত্ব। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সরকার মিডওয়াইফ’র মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জরুরি প্রসব সেবাসহ প্রসবকালীন জটিলতায় সঠিক রেফারেল সেবা চালু করেছে। ফলে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হলেও কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস)-এর তথ্যানুযায়ী কাঙ্খিত অগ্রগতি না হলেও দেশে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, ৯০-এর দশকে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৫৭৪ জন গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হতো। ২০১৯ সালে যা কমে দাঁড়ায় প্রতি লাখে ১৬৫ জন। সেই হিসাবে ৯০-এর দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ৭০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, সরকার মাতৃমৃত্যু হার লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭ দশমিক এক শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে শতভাগে উন্নীত করতে হবে।
কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, আধুনিক যন্ত্রপাতির যেমন অভাব রয়েছে। মাতৃত্বকালীন নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে দেখা দেয় স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার অভাব। মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোও শতভাগ মান সম্মত নয়। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়হীনতাই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: ইশরাত জাহান বলেন, ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর খবরগুলো অত্যন্ত দু:খজনক। এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একজন নারীর গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া এবং প্রসব পরবর্তী সব ধরণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া তার নাগরিক অধিকার। এমনকি শিশুর গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা যেমন নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিরোধ বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যকে পালনের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম বলেন, দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। যাদের ৫৬ ভাগই মারা যায় প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এসব মাতৃমৃত্যুর ৩১ শতাংশই ঘটে রক্তক্ষরণের কারণে। ২৪ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া। এছাড়া ৩ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে বাধাগ্রস্ত বা অবিরাম প্রসব ব্যথার কারণে। মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৩ ভাগই ঘটে থাকে বাড়িতে প্রসবের কারণে। তাই বাড়িতে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত ক্লিনিক ও হাসপাতালে নিতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে এই কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও যথাযথ উদ্যোগ নিলে দ্রুত সুফল পাওয়া সম্ভব।
মেরি স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি লিড (প্রধান) মনজুন নাহার বলেন, নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং সবার জন্য পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেরি স্টোপস-বাংলাদেশ। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৩৭টি উপজেলার ৩২৩টি ইউনিয়নে কাজ করছেন তাঁরা। যার ফলে ইউনিয়ন পরিষদগুলো জাতীয় বাজেটের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে এই খাতে পৃথক বরাদ্দ রাখছে। একইসঙ্গে সেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পরিষদ এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি আরও জানান, বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার ষাট গম্বুজ ইউনিয়নে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার এখন শুন্য। এই সফলতার পিছনে কাজ করেছে গত তিন বছরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে পৃথক বাজেট বরাদ্দ। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সমন্বিত পদক্ষেপও তৃণমূলে সেবা নিশ্চিত করতে বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। শুধু ষাট গম্বুজ ইউনিয়ন নয়, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে সারা দেশে এ ধরণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ে দাবি বলে তিনি জানান।
###
পার্লামেন্টনিউজবিডি.কম; ২৮ মে ২০২২ইং
Be the first to comment on "পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার মাধ্যমেই কমে আসবে মা ও শিশু মৃত্যু হার"